মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে জঙ্গিবাদে ‍দুই বন্ধু

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মেধাবী ছাত্র হিসেবে এলাকায় বেশ পরিচিতি রয়েছে সাদমান আরেফিন ফাহিমের (২১)। সফলতার সঙ্গে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ শ্রীকোল গ্রামের বাসিন্দা এই তরুণ। তার বাবা হামিদুল হক প্রবাসফেরত ব্যবসায়ী।

এত সফলতার মাঝেই হঠাৎ গত ২৬ জুলাই থেকে নিখোঁজ হয়ে যান ফাহিম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান পায়নি পরিবার। নিখোঁজের ২৩ দিন পর খবর আসে দেশের নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহদীর কাফেলা’য় যোগ দিয়েছেন তিনি।

একইভাবে ২৩ দিন আগে নিখোঁজ হন ফাহিমের বন্ধু রামু উপজেলার মধ্যম মেরুংলোয়া এলাকার ইরতেজা হাসনাত লাবিব (২২)। তার মা-বাবা দুজনই সরকারি স্কুলের শিক্ষক। পরিবারটির বেশ সুনামও আছে এলাকায়। মা-বাবার মতো মেধাবী হিসেবে লাবিবও বেশ পরিচিত। তবে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সহজভাবে নিচ্ছেন না এলাকাবাসী। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকলে শাস্তিও চান তারা। একই কথা বলছে ফাহিম ও লাবিবের পরিবার। লাবিবের অপরাধের দায় নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার বাবা স্কুলশিক্ষক এনামুল হক।

গত সোমবার ‘ইমাম মাহদীর কাফেলা’ নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সন্দেহে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার নির্জন এলাকা থেকে ১৭ জনকে আটক করে ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম’ (সিটিটিসি)। তাদের মধ্যে দুজন ফাহিম ও লাবিব।

ওই দিন রাতে ‘সিটিটিসি’র ইউনিটপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল, সেই তথ্যের সঙ্গে আস্তানার মিল আছে। নতুন এই সংগঠনটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। গত শনিবার ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। পরে সোমবার আরও ১৭ জনকে আটক করা হয়। আটক সবাই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।’

ফাহিম তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে রামুর খিজারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছেন তিনি। মাঝখানে এক বছর পড়েননি। কক্সবাজার সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন তিনি। পড়াশোনার সুবাদে কক্সবাজার শহরের রুমালিয়ার ছড়া এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন তিনি।

বাবা হামিদুল হক ২১ বছর সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। মা হাসিনা বেগম গৃহিণী। পেশায় বাবা সুতার ব্যবসায়ী। নিজেদের দোতলা বাড়ির নিচেই দোকান আছে হামিদুরের।

জানতে চাইলে হামিদুল হক বলেন, ‘গত ২৬ জুলাই কাজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। তার পর থেকে নিখোঁজ। ফোনও বন্ধ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি। তিনি ধৈর্য্য ধরতে বলেছিলেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ছেলে ফেরেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফাহিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। শান্ত স্বভাবের। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলাও ছিল না। পড়াশোনার জন্য চাপ দিতাম। অন্য কোনো বিষয়ে তার সঙ্গে কখনো কিছু হয়নি। কীভাবে এখানে গেল, তা আমরা কখনো বুঝতে পারিনি।’

এতদিন ধরে নিখোঁজ ছেলে থানায় জিডি করেননি কেন- জানতে চাইলে হামিদুল হক বলেন, ‘মেম্বার আর চেয়ারম্যান ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম।’

ফাহিমের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে কখনো এমন ছিল না। কত কষ্ট করে পড়াশোনা করছিল। চাকরিও করে। যেদিন যাচ্ছে সেদিনও কত সুন্দরভাবে কথা বলে গেছে। নিশ্চয় কেউ আমার ছেলেকে ব্যবহার করেছে।’

ফাহিমের জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিললে তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছেন মা হাসিনা বেগম।

ফাহিমের ছোট ভাই মাহির আরেফিন ফারদিন বলেন, ‘কখনো ভাইয়ার মুখে এসব বিষয়ে কিছুই শুনিনি। বড় ভাই হলেও আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম। এলাকায় তেমন চলাফেরা ছিল না। চাকরি ও পড়াশোনার জন্য কক্সবাজারে বেশি সময় দিতেন। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে থাকতেন। এলাকায় বন্ধু বলতে লাবিব ভাইয়াই ছিল।’

চলতি বছরের ২৬ মার্চ ডেলিভারি কর্মী হিসেবে পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিসের কক্সবাজার শাখায় যোগ দেন ফাহিম। যেখানে তার মূল বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা। আর প্রতি ডেলিভারিতে তিনি কমিশন বাবদ পেতেন ৩০ টাকা করে।

সেখানেও তিনি সর্বশেষ গিয়েছিলেন ২৫ জুলাই দুপুরে। তার পর থেকে পাঠাও কর্তৃপক্ষও তার খোঁজ পায়নি বা ফাহিমও যায়নি বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।

‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিসে’র কক্সবাজার শাখার অপারেটর রানা দাশ বলেন, ‘২৫ জুলাই থেকে ফাহিমের খোঁজ নেই। তার ভাই পরিচিত আমাদের একজন স্টাফ আছে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ফাহিম কেন আসছে না। সে বলেছিল তিনিও খোঁজ পাচ্ছেন না।’

শিক্ষক মা-বাবার সন্তান লাবিবও এলাকায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে বেশ পরিচিত। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি কক্সবাজার সিটি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।

পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে লাবিবের প্রায়ই ঝগড়া হতো। অনেক সময় বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন লাবিব। নিখোঁজের পর ছেলে পরীক্ষার আগে ঘরে ফিরবেন- এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন মা।

লাবিবের বাবা স্কুলশিক্ষক এনামুল হক বলেন, ‘২৬ জুলাই আমরা দুজনই স্কুলে ছিলাম। সকালে বের হওয়ার সময় কথাও বলেছি ছেলের সঙ্গে। কলেজে যাবে বলে ব্যাগ নিয়েছিল। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। জিডি নিজে হাতে লিখছি থানায় যাব বলে। কিন্তু তার মায়ের দাবি ছিল পরীক্ষার আগে হয়তো ফিরবে। তাই থানায় যাইনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের অপরাধের দায় আমরা কখনো নেব না। জামিনও চাইতে যাব না।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006026029586792