মেধাবীদের নিয়ে ঢাকঢোল, ব্যর্থতায় পিছুটান!

অলোক আচার্য |

মেডিক্যাল, বুয়েট বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার পর আমাদের দেশে দেখা যায় যে ছেলে বা মেয়েটি প্রথম বা ভালো অবস্থানে আছে এবং বিশেষত প্রথম জনকে নিয়ে এক ধরনের টানাহেঁচড়া শুরু করে কোচিং সেন্টারগুলো। প্রত্যেকেই দাবি করে সে তাদের কোচিং সেন্টারে প্রস্তুতি নিয়েছে! এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সত্যি কথা বলতে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো অবস্থান তৈরি করার পেছনে সেই ছাত্রছাত্রীর মেধা নয় বরং সেই কোচিং সেন্টারের ভূমিকাই প্রধান। এ বিষয়টা কি একটু আশ্চর্যজনক না! উন্নত কোনো দেশে এই চিত্র আছে মানে এই টানাটানি আছে বলে আমার জানা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে কম আলোচনা হয় না। এই যে একজন মেধাবীর ছবি নিজেদের কোচিং সেন্টারের বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে টাঙিয়ে ভর্তি করার প্রবণতা এটা কি অতিমাত্রায় বাণিজ্য নয়? এটুকু না করলে কি ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবেন না? এই হীন কাজটুকু করার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকেই হাস্যকর এবং প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।

কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিবর্তিত কারিকুলাম অনুযায়ীই এখন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হবে। এই কারিকুলামের একটি উদ্দেশ্যই ছিলো কোচিং বা প্রাইভেট নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা। কিন্তু এখনো তা বলা সম্ভব হচ্ছে না যে আদৌ সেটা হবে কি না? বা হলেও কতোটা? উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেই ছাত্রছাত্রীরা ছুটতে থাকে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের দোরগোড়ায়। সেই ছোটাছুটি দেখলে যে কেউ মনে করবেন কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হলে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যাবে না অথবা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না? এই বিশ্বাসটাই এতোদিনে এক ধরনের আত্নবিশ্বাসে পরিণত হয়েছে! এবং যারা মোটা টাকা খরচ করে কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারছে না তারা যদি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ভর্তি হতে না পারে তাহলে অবলীলায় দোষ দেয় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে না পারার! অর্থাৎ কোচিং সেন্টারই মেধা বিকাশের প্রধান কেন্দ্র! শিক্ষাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে কোচিং সেন্টার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু যখন প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে কোচিং সেন্টার এবং শিক্ষকদের নাম আসতে থাকে তখনই এই বিষয়ে নেতিবাচক ধারণার তৈরি হয়েছে। এটা তো সত্যি যে কোচিং এখন একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।

যেখানে লক্ষ্য ছিলো একটু অতিরিক্ত পড়ানো বা শেখানো বা চর্চা করানো। সেখান থেকে কার কয়টা ছাত্রছাত্রী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত! আর অভিভাবকদেরও এই ধারণা মজ্জাগত হয়েছে যে কোচিং করলেই তার সন্তানের যাবতীয় মেধার বিকাশ ঘটা সম্ভব! এডুকেশন ওয়াচের গবেষণায় বলা হয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশ নির্বাহ করে পরিবার। এই অর্থের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় হয় কোচিংয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোচিংয়ে আটকা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অধীন উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প গবেষণা করে দেখেছে, ভর্তি-ইচ্ছুক প্রতিজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে (এক সিজন) ভর্তি কোচিং ও আনুষঙ্গিক বাবদ খরচ হচ্ছে প্রায় ৪৩ হাজার টাকা। প্রকাশিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী কোচিং করেন। সরকার কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে একটি নীতিমালা প্রকাশ করে। সেখানে একজন শিক্ষকের জন্য তার প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ১০ জন শিক্ষার্থী পড়ানোর সুযোগ রাখা হয়। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে শুধু অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ের জন্য মেট্রোপলিটন শহরে মাসিক ৩০০ টাকা, জেলা শহরে ২০০ টাকা এবং উপজেলা বা স্থানীয় পর্যায়ে ১৫০ টাকা করে রসিদের মাধ্যমে নেয়া যাবে। কিন্তু এতোসব কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে আর কতোটা হয়নি তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। বর্তমান কারিকুলামে ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট বা কোচিং নির্ভর হতে হবে না এটাই আশা করা হচ্ছে বা এই লক্ষ্যেও কারিকুলাম প্রনয়ণ করা হয়েছে। এই নতুন কারিকুলামের শুরু থেকেই এর পেছনে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা চলেছে। কেউ কেউ না বুঝেই অহেতকু মুখ বাঁকিয়ে শিক্ষা গেলো শিক্ষা গেলো রব তুলছেন! তবে বাস্তবতা বুঝতে চাইছেন না।

বুঝতে চাইছেন না দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটছে এখন। আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখতে হবে। আমাদের সন্তানদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আজ না হোক কাল তো এটা করতেই হবে। সবকিছু যদি আধুনিক ধারায় পরিবর্তন করতে পারি তাহলে শিক্ষা পদ্ধতির কেনো পরিবর্তন হতে পারে না। কেনো পাবলিক পরীক্ষায় ফেল করে কয়েকজন আত্নহত্যা করবে। কেনো শিক্ষা জীবন শেষ করার পরেও বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে পায়ের তলা ক্ষয় করবে? নিজে কিছু করতে পারবে না কেনো? সবচেয়ে বড় কথা সবেমাত্র প্রয়োগ হচ্ছে। এটা প্রয়োজনে পরিমার্জন হতেই পারে। কিন্তু এই উচ্চ শিক্ষা স্তরে বা প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় কোচিং সেন্টারগুলোর এই ধরনের টানাহেঁচড়া আদৌ বন্ধ হবে কি? বহু বছর ধরে আমাদের দেশে পাস-ফেল ও লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতির প্রচলন ছিলো। শিক্ষা বলতেই আমরা বুঝতাম প্রতিযোগিতা। শিক্ষা বলতেই আমরা বুঝেছি কে কতো ভালো ফলাফল করতে পারে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই নীতিতে শিক্ষা চলে এসেছে। ততোদিনে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক কাঠামো বদলে গিয়েছে। পারিপার্শ্বিক চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষতার সংজ্ঞার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছিলো না শিক্ষাব্যবস্থার। ঠিক এই নীতির কারণেই অভিভাবকরা হন্যে হয়ে তার আদরের সন্তানকে দিনরাত পড়ালেখায় ব্যস্ত রেখেছে বা এখনো রাখছে। কারণ, তার সন্তানকে ভালো ফল করতেই হবে। আর এর কারণেই তার দিনরাত প্রাইভেট পড়তে হয়েছে এবং কোচিংয়ে ভতিং হতে হয়েছে।

এতো কিছুর পর যখন ভালো রেজাল্ট হয়েছে তখন চাপ এসেছে কোনো নামীদামি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো কোনো সাবজেক্টে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা। এটা এমন একটা মানসিক চাপ যে কিছুদিন আগে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় একটি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর লঙ্কাকাণ্ড এবং এর পেছনের মানসিক পারিবারিক চাপের কথা প্রকাশ্যে আসার পর তা অনুধাবন করা যায়। আশা করা আর পরিবার থেকে চাপ দেয়া ভিন্ন বিষয়। এর জন্য আবার একগাদা টাকা খরচ করে কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। অর্থাৎ এই প্রাইভেট কোচিংয়ের হাত থেকে মুক্তি মেলেনি। এরপর যখন কোনো একজন কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ভর্তি হতে পেরেছে তখন কিন্তু তাকে নিয়ে সেই রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। অর্থাৎ তখন সে প্রায় প্রতিটি কোচিং সেন্টারেই পড়ালেখা করেছে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু যারা চান্স পেলেন না তাদের কথাও কি এভাবে বলছে? মানে কতোজন অকৃতকার্য হচ্ছে বা টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পেলেন না সে হিসাব তো কেউ দিচ্ছে না। অর্থাৎ সাফল্যের ভাগীদার হচ্ছে সকলেই কিন্তু ব্যর্থতার দায় কেউ নিচ্ছে না। সাফল্য হলে তা কোচিং সেন্টারের আর ব্যর্থ হলে তা ছাত্রছাত্রীর নিজের দায়! তাদের কথা কেউ বলছেন না। কোচিং করার পরেও কেনো তারা ব্যর্থ সেই উত্তর কেউ দিচ্ছে না। আর একজনকে নিয়ে চলে টানাটানি। এসব পরিস্থিতি রীতিমতো হাস্যকর। শিক্ষায় পরিবর্তন আসতে চলেছে। ইতিমধ্যে সেই কার্যক্রম চলছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোয় প্রত্যেকের মেধা বিকশিত হবে। তখনই এসব বন্ধ হয়ে যাবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030488967895508