আমরা রওনা দিলাম তেওটিহুয়াকনের উদ্দেশ্যে। পথে বেশ কিছু জায়গা থেকে ছবি তুলি। মেক্সিকো সিটি থেকে তেওটিহুয়াকানের দুরত্ব প্রায় ৪৯ কি.মি, যেতে ৪৫/৫০ মিনিট লাগবে। তেওটিহুয়াকান, শহরটিকে বলা হয়, এটি একটি না হুয়াচল নাম যার অর্থ “যে জায়গাটিতে দেবতাদের সৃষ্টি করা হয়েছিল” এবং এটি ৭ম শতাব্দীতে পরিত্যক্ত হওয়ার কয়েক শতাব্দী পরে মেহিকো (কখনও কখনও অ্যাজটেক নামে পরিচিত) হয়। এটি সত্যিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যের একটি। তেওটিহুয়াকানের আশেপাশের অঞ্চলটিতে প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বসতি স্থাপন করা হয়েছিল। ১০০-২৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অসাধারণ অগ্রগতি ঘটেছিল যার সময় সূর্য ও চাঁদের পিরামিডের মতো অনেক আইকনিক পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। তেওটিহুয়াকান সম্পর্কে সবচেয়ে আশচর্যজনক তথ্যগুলির মধ্যে একটি হল, এটি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা পিরামিডগুলির একটি এবং এখানে বসবাসকারী বিশাল জনসংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। যেন তারা কোনো চিহ্ন ছাড়াই হারিয়ে গেছে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমরা তেওটিহুয়াকানে পৌছাই এবং ড্রাইভার ইভান আমাদেরকে টিকিট কাউন্টার দেখিয়ে দেয়। আমরা সবাই টিকিট কাটলাম ১৮০ পেসো নিলো, এক ডলারে ১৮.৫০ পেসো পাওয়া যায় । টিকিট কাটার পর পিরামিডে প্রবেশের মুখে সারিবদ্ধভাবে দু’পাশে কিছু দোকান রয়েছে। সবই স্যুভেনিরের দোকান। মুনির ভাই ও ইনান ভাই মেক্সিকান টুপি কিনলেন। মাহফুজ ভাই দাবা বোর্ড সংগ্রহ করেন, উনার বাসায় শতাধিক বিভিন্ন দেশের দাবা বোর্ডের বিশাল সমারোহ। মেক্সিকান স্যুভেনিরগুলি বেশ রঙিন, চাকচিক্যময়। তবে দাম ও কম নয়। দামাদামি করতে হয়। যেহেতু ট্যুরিস্ট তাই দামাদামি স্বাভাবিক।
প্রচণ্ড গরম, ভর দুপুর এখন। সবাই সানগ্লাস বের করল। মুনীর ভাই ডিএসএলআর ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত, আমরা যার যার মোবাইলে। মেহিকোর ভাষা স্প্যানিশ/ বেসিক স্প্যানিশ ভাষার উপর কোর্স করার সুবিধা পাচ্ছি? স্থানীয় লোকজনের সাথে অন্তত শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে, কেনাকাটার ক্ষেত্রে দামাদামি করতে পারছি। একটি দোকানে সবাই যাই, মাহফুজ ভাই দাবা বোর্ড কিনবেন। কানে বাজল “ও খালাকে? ইনডিয়া? স্প্যানিশ ভাষায় “ও খালা কে” মানে হবে মে বি (হতে পারে)। দোকানি ও তার ছোট্ট মেয়ে আমাদেরকে দেখে বলছে, ওরা মনে হয় ভারতীয়?
ভর দুপুর। তবুও লোকজনের বসতি নেই। কানে বাজল জাগুয়ারের ডাকের শব্দ। পরে দেখি কিছু মেহিকান এক প্রকার যন্ত্র নিয়ে মুখ লাপিয়ে ফুঁ দেয় এবং সেখান থেকে এই শব্দের উৎপত্তি।
পাথর দিয়ে আজটেক ক্যালেন্ডার ও নানাবিধ স্যুভেনিরে ভরপুর। বাহারি রংয়ের কাপড় দিয়ে শানা, টুপি দেখলাম। একমাস থাকব। তাই প্রথমেই কিছু কিনলাম না কিন্তু মনির ভাই, মাহফুজ ভাই, ইনান ভাই কিছু স্যুভেনির কিনলেন। পর্যটনের সাথে স্যুভেনিরের একটা সম্পর্ক আলাদা। আমরা আজও এটাকে কাজে লাগাতে পারলাম না। স্যুভেনিরের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য যেমন তুলে ধরা যায়, ঠিক তেমনি মেলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। মেক্সিকোতে ৩৪ টি স্পট unesco world heritage এর আওতায়। Teotithuacan ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এর অন্তর্ভুক্ত হয়। আমাদের অনুজপ্রতিম বিখ্যাত ভূ পর্যটক, লেখক তারেক অনুর প্রথম বই “পৃথিবীর পথে পথে” বইটিতে এই তেওটিহুয়াকানসহ মেক্সিকোর অন্য শহরেরও বর্ণনা আছে।
ইনান ভাই সবার জন্য পানি কিনলেন এবং আমাদের সবাই ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে চলছি তেওটিহুয়াকান পিরামিডের দিকে। উঁচু জায়গা থেকে বলে সবকিছু যেমন পরিষ্কার, ঠিক তেমনি নীচে অবস্থানরত মানুষকে ছোট্র লাগছে। প্রায় চল্লিশ বর্গ কি.মি জুড়ে এক প্রাচীন আশ্চর্য শহর তৈরি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব একশো পঞ্চাশ থেকে সাতশো খিষ্টাদ্ধের মধ্যে। হাজার বছর ধরে যার প্রভাব পুরো মধ্য আমেরিকার শিল্প সংস্কৃতিতে পড়েছে।
তেওটিহুয়াকান শহরকে ঘিরে উঠা এই সভ্যতার নাগরিক সংখ্যা ছিল একশো হাজারেরও বেশি। প্রাচীন দিনের অন্যতম বিশাল নগরী যা সাজানো হয়েছিল দু হাজার শিল্পসম্ভারের সৃষ্টিকাজে। চাষিরা থাকত কাঠের বাড়িতে শহরের উপকন্ঠে, বনে। পাথরের তৈরি বাড়ি ছিল, মাটির নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানি পরিসরণের নালি যার ধ্বংসাবশেষ দেখে এখনও অবাক হয়ে যায় আজকের মানুষ। তেওটিহুয়াকান পরিচয় আজ কোনও একটি অলংকৃত স্তম্ভে, প্রাচীরচিত্রে, পিরামিডের গায়ে লেখা। খুব বেশী তথ্য এদের সম্পর্কে পাওয়া যায় না। এখানে যারা বাস করত, কি নাম ছিল তাদের, নগরের নামই বা কী ছিল জানা যায়নি। তেওটিহুয়াকান নামটিও সাতশো বছর পরের সভ্যতার মানুষ আজটেকদের দেওয়া। এই পবিত্র রহস্যময় ভগ্নস্তূপে তারা আসত তীর্থযাত্রায়। সূর্য ও চন্দ্র পিরামিডের নামও আজটেকদের দেওয়া। মন্দিরের সিড়িঁগুলির ধাপে ধাপে সর্পদেবতার মূর্তি। মুখের দুপাশে কী ভয়ংকর দাঁত।
মানুষের চেয়ে দোকানদার বেশী। বিভিন্ন রকমের স্যুভেনির নিয়ে বসে আছে। কিন্তু কাউকে বিরক্ত করছে না বা ডাকছে না। যার যার পছন্দ হলে দরদাম করছে। এখান থেকে কিছু কেনা উচিত ছিল তা পরবর্তীতে শহরগুলির স্যুভেনির শপে গিয়ে বুঝতে পেরেছি। যেহেতু তাদের এখানে বিক্রেতা সরাসরি বিক্রি করেন এবং জায়গার ভাড়াও হয়ত দিতে হয় না বা হলেও তা কম, এখানকার মূল আকর্ষণ হলো সূর্যের পিরামিড এবং চাঁদের পিরামিড। তারা আপনাকে তাদের আশ্চর্যজনক নির্মাণে বিস্মিত করবে। সূর্য মাথার উপর থাকায় দীর্ঘক্ষণ বসে ভাববার সুযোগ নেই। এখানে আসার ভাল সময় হবে সকালে আসা এবং সবচেয়ে ভাল হয় ৯টার দিকে। কারণ এটি ভাল করে ঘুরে দেখতে হলে হাতে দুই/ তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে আসা উচিত। আবহাওয়ার দিক থেকে চিন্তা করলে বছরের মার্চ- মে, অক্টোবর হচ্ছে ভাল সময়। শহরের কাছাকাছি থাকায় প্রচুর ছাত্র- ছাত্রীও ডেট্রিবা দিয়ে থাকেন। এটি মেহিকোতে সবচেয়ে বেশী দেখা প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট। মাঝে মাঝে আমরা ৪ জনই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আবার একত্রে মিলিত হই বিশেষ করে স্যুভেনির কেনার সময়।
আমরা হাঁটতে থাকলাম। বিশাল রাস্তা। সমস্ত প্রধান কাঠামো অ্যাভিনিউ অব দ্য ডেডের সাথে সংযুক্ত- একটি দীর্ঘ রাস্তা যা সরাসরি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি সেরো গোর্ডের মুখামুখি। একটি কথা বলে রাখা ভালো, বিকেল পাঁচটার পর এখানে থাকা নিষেধ। এটি আমি পরবর্তীতে চিচেন ইৎজাতেও দেখেছি। ৫টা বাজার সাথে সাথে সিকিউরিটি গার্ড এসে তাড়া দিতে থাকেন উপস্থিত সকলকে। মনে রাখবেন, রোববার কখনও আসবেন না। কারণ সেদিন মেক্সিকানদের জন্য প্রবেশ ফ্রি। তাই উপচেপড়া ভিড় থাকে সেদিন। আমরা সূর্য পিরামিড দেখা শেষ করে হেঁটে চাঁদ পিরামিডের দিকে হাটছি। ছোট পিরামিড এবং প্ল্যাটফর্ম দ্বারা বেষ্টিত চাঁদের পিরামিডটি অ্যাভিনিউ অব দ্য ডেডের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এবং দক্ষিণ দিকে মুখ করে। ৪২৫ বাই ৫১১ ফুট পরিমাপের ভিত্তিসহ ১৪০ ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে, চাঁদের পিরামিডটি তেওটিহুয়াকানের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাঠামো।
পুরো শহরে একটি রহস্য জড়ানো। কারা বাস করত এখানে? কে নির্মাণ করেছিল? কি ছিল তাদের রোজকার জীবনযাত্রা? কোনও সদুত্তর নেই, কোন দেবতাকে পূজা করত কিছুই জানা যায়নি। ৭০০ খিষ্টাব্দের পর আর কেন জীবনের কোনও চিহ্ন থাকলো না। কোথায় গেলো এমন সৃষ্টিশীল মানুষেরা? প্রত্নতাত্ত্বিকেরা গবেষণা করে বলেছেন, এক বিরাট অগ্নিস্তূপ থেকে উঠে দাড়াঁতে পারেনি, এক বিশাল সভ্যতার ছাপ রয়ে গেল শুধু স্বপ্নময় ভগ্নস্তূপে। আজকের মেক্সিকানরা স্বদেশি ও ইউরোপিয়ান রক্তে মিশে Mestizo দুই সংস্কৃতি এক ধারায় বইছে তবু থেকে যায় ধূপের ধোঁয়ার মতো প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস, আচার- বিচার।
মিশরের পিরামিড পৃথিবী বিখ্যাত। সেখানে প্রায় ১১৮টি পিরামিড রয়েছে। এছাড়াও যে সমস্ত দেশে পিরামিড রয়েছে সেগুলি হল- সুদান, মেহিকো, ইতালি, ইরাক, পেরু, গুয়েতেমালা ইত্যাদি।
মিশরের পিরামিড সবচেয়ে পুরাতন, প্রায় ৪৭০০ বছর আগের। গিজার মিশরীয় পিরামিডগুলেঅর তুলনায় মায়ান পিরামিডগুলো বেশির ভাগই ছোট, তবে খাড়া এবং আরও অলংকৃত।
লেখক : আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন