অনেক আক্ষেপ নিয়ে মনীষী আহমদ ছফা বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয় ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো জিনিস নয়। টাকা দিয়ে আসবাবপত্র কেনার মতো করে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আত্মা থাকতে হয়। ইট, কাঠ, লোহালক্কর দিয়ে ইমারত বানালে সেখানে আত্মার সঞ্চার হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় দূরের কথা, একটা স্কুল বা কলেজ গড়ে তোলার জন্য দুই দশক আগেও শহর থেকে অনেক দূরের মানুষগুলোর মনের মধ্যের আকুলতা আমরা ভুলতে পারি না। ১০, ১৫ বা ২০ কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল বা কলেজ ছিলো না এমন জনপদের মানুষ কীভাবে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ডের নানা ধাপ পেরিয়ে অনুমতি নিয়ে, টাকা সংগ্রহ করে, জমি দিয়ে, বাঁশঝাড়ের বাঁশ দিয়ে, ১ হাজারটা ইট দিয়ে, যার কিছু নেই সে কায়িকশ্রম দিয়ে, জনে জনে যে যতটুকু পেরেছেন, তা মিলিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলতেন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই স্কুলে, সেই কলেজে যেদিন প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছিল সেদিনের কথা ভেবে চোখ ভিজে ওঠা, সেই ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সন্তানের কাছে পুরনো স্মৃতিগুলো বলতে আত্মার সঞ্চার হওয়া মানুষের সংখ্যা এদেশে এখনো কম নয়।
সেই দেশে উঠতি রাজনীতিক, উঠতি টাকার মালিকের সাথে বসে, কখনো আইনের ফাঁক-ফোকর বের করে, কখনো আইনের সব অক্ষর হটিয়ে দিয়ে, সরকারি অফিসে বসে, দিনে দিনে রাতে-রাতে স্কুল নয়, কলেজ নয়, একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির নথিপত্র তৈরি হতে পারে-এটা বিশ্বাস করার জন্য নিশ্চয় আপনি অথবা আহমদ ছফা প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবতা আরো করুণ। অসততা আরো অসৎকেই ডেকে আনে, বাহুবন্দি করে। সম্প্রতি ঢাকার লালবাগে সনদ তৈরির নানারকম যন্ত্রপাতি আর সনদ উদ্ধার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগ। প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ সনদ, নম্বরপত্রের সন্ধান মিলেছে সেখানে।
দেশে এখন শিক্ষাকার্যক্রম চলছে ১০২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে কতটা মাটির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে, কতজন স্থায়ী শিক্ষক, কে হবেন উপাচার্য, কতটা ক্লাসরুম, বিষয়ভিত্তিক কত বড় লাইব্রেরি থাকতেই হবে তার জন্য আইনের বিধান রয়েছে। এদেশে যত পরে জন্ম নিয়ে ডিজিটাল সিকিওরিটি অ্যাক্ট যত আলোচনায় এসেছে, ৩০ বছর আগের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন তার ধারেকাছেও আসেনি। এ দুই আইনের ব্যবহারের তারতম্য দেখে গ্রাফ বানালে, না জানি তা কতটা কিম্ভূতকিমাকার দেখাবে।
একবার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম সরকারের বেঁধে দেয়া নথিতে কীভাবে হিসেব দিতে হয় ফ্যাকাল্টির। ফলে এটা নিশ্চিত, পুলিশ যেমন সবারই ঘরের খবর জানে ঠিক তেমনি, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরটা কতটা ফাঁকা তার নথি ঠিক জায়গামতোই আছে। ফাঁকটা ওপরেও আরো স্পষ্ট, যেমন যিনি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথা তিনিই নেই। রাষ্ট্রপতির মনোনীত আছেন ৭০ জন। কোথাও আছেন উদ্যেক্তাদের মনোনীত বা মনের মতো। পত্রিকায় খবর বের হয়, কখনো ৩০ কখনো ৩৮, কখনো ৩২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যহীন। উপাচার্য বনাম উদ্যোক্তায় ব্যবসার বনিবনা হয় না।
তবুও তো ঠিক মতো চলছে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়। সমস্যাটা হচ্ছে যে আইন, যে বিধান জারি করে রাষ্ট্র লাভবান বা কল্যাণকর সমাজ গড়তে চেয়েছিল সেই আইনে শুধুই মুষ্টিমেয় ব্যক্তি লাভবান হচ্ছেন। যত আইন, যত বিধান তার বরখেলাপ করতে, সেটা দেখিয়ে তত টাকার বাণিজ্য গড়ে উঠছে। সমস্যা হচ্ছে পাবলিক পরীক্ষায় বছরের পর বছর প্রশ্ন ফাঁস, যা মানতে না পেরে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বসে পড়েছিলেন। সমস্যা শত সহস্র গোল্ডেন জিপিএ-৫ ধারীর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাসমার্ক না পাওয়া, আর সমস্যা এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার সনদ লাভ করা যেখানে কখনো ক্লাস-ই হয়নি। এই যে বিপুল জনগোষ্ঠীর অন্ত:সারশূন্য হয়ে বেড়ে ওঠা-এর অভিঘাত কী।
পত্রপত্রিকার খবর, ১০২টির পর আরো ৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। শুধু তাই নয়, এসব খবরের চেয়েও যেনো বড় খবর এসেছে বড় বিজ্ঞাপন দিয়েই। এক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা যাত্রা শুরুর আগে তাদের টাকার গরিমায় সেই পুরনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। এক অদৃশ্য ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়ায় ঘোড়ার আগে জুড়ে পড়েছে পুরো গাড়িই। বিদেশি স্টাডি সেন্টারের আবেদন, যাচাই-বাছাই-পরিদর্শন-সুপারিশ-নিয়ন্ত্রণ-সবকিছু যাদের হাতে সেই মঞ্জুরী কমিশনের কাছে নাজিল হয় এক নথি। মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশে কমিশন তড়িঘড়ি করে যথাজ্ঞা জানিয়েছে সব।
অভিযোগ উঠেছে, মঞ্জুরী কমিশনের অনুমোদন পাবার ২৬ দিন আগে পহেলা মার্চ স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী সেই ক্যাম্পাস ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন। আর এই মে মাসে মঞ্জুরী কমিশন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে শোকজ করেছে। যেখানে একাডেমিক কাজ চলার আবেদন-ই না করে জাতীয় পত্রিকায় শিক্ষার্থী ভর্তির বিজ্ঞাপন দেয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে।
আহমদ ছফা বলতেন, ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে আর যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। অনুমোদন দেয়ার আগেই ওপরের কর্তাদের উদ্বোধন, আবার উদ্বোধনের পরেই শোকজ-এমন সব অবিশ্বাস্য ঘটনার বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় এক নতুন নজির স্থাপিত হয়েছে বঙ্গদেশে। যেখানে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনার বিধিমালা তছনছ করা হয়েছে। সেই সাথে শঙ্কা জেগেছে, লালবাগ থেকে দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে যাদের অভক্তি ছিল তারা দেশে বসেই কী বিদেশের সনদ পাবার সুযোগ পেয়ে যাবেন?
এ দেশে এখনও একটা নতুন হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অনেক কঠিন নিয়ম-কানুনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রক্রিয়াটাও দীর্ঘ। ধর্ণা দিতে হয় অনেক ঘাটে। কিন্তু এ দেশে অনুমোদনের আগেই বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করা হয়। স্কুলের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এমন সহজ মওকা আর কোথাও কি পাওয়া যাবে?