একটা ভাষাকে বাঁচানোর লড়াইযে ভাষায় এখন কথা বলেন মাত্র ছয় জন

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বান্দরবানে বিলুপ্তপ্রায় ‘রেংমিটচ্য ভাষা’ বাঁচাতে ম্রো জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের নিয়ে শুরু হয়েছে ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম। আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নের তৈন মৌজায় দুর্গম ক্রাংসি পাড়ায় ‘রেংমিটচ্য ভাষা পরিবারে’ এক সদস্যের বাড়িতে ১ ডিসেম্বর থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়।

‘রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার’ উদ্যোক্তা ও ম্রো ভাষার লেখক ইয়াঙান ম্রো বলেন, শিশু-কিশোর ও মধ্য বয়স্ক মিলে মোট ৩৫ জন ম্রো ও রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার্থী এই শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। শুরুতে ২১ জন ছিলো। এখন ৩৫ জন শিক্ষার্থী হয়ে গেছে।

প্রত্যেক সন্ধ্যায় একজন রেংমিটচ্য ভাষা পরিবারের বাড়িতে চলছে এই কার্যক্রম। শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন রেংমিটচ্য ভাষীর মাংপু ম্রো ছেলে সিংরাও ম্রো। গত বছর রেংমিটচ্য ভাষা শব্দভান্ডার নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মূলত এই বই থেকে তাদের ভাষা শিক্ষা পড়ানো হয়।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৈন মৌজার দুর্গম ক্রাংসি পাড়ায় প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় শিশু-কিশোরদের পড়ানো হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় ‘রেংমিটচ্য ভাষাশিক্ষা’।

ইয়াঙান ম্রো বলেন, “চোখের সামনেই একটা ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে এটা মানতে পারি না। যতটুকু সম্ভব এই ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রেংমিটচ্য ভাষার অক্ষর না থাকায় বাংলা শব্দ দিয়ে রেংমিটচ্য শব্দভান্ডার নামে একটি বই গত বছর বের করেছি। এতে তিন হাজারের বেশি শব্দ রয়েছে। গত দশ বছর ধরে এই শব্দগুলো সংগ্রহ করেছি আমি।

ইয়াঙান ম্রো বলেন, বইটিতে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, তরকারি, খাদ্য, খেলাধুলা, দিন ও মাসের নাম রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রেংমিটচ্য ভাষার বাক্য ও এই ভাষায় গণনাও রাখা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এগুলো শেখানো হচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে সিংরাও ম্রো নামে যিনি রয়েছেন তিনি রেংমিটচ্যভাষা পরিবারের একজন। বাংলা ও ম্রো ভাষায় লেখা রেংমিটচ্য শব্দভান্ডার বইটি তিনি ম্রো ভাষা দিয়ে পড়ান।

স্থানীয়রা জানান, ম্রো এবং রেংমিটচ্য ভাষা পরিবারের শিশুদের মধ্যে এই ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। পরবর্তীতে সবার সহযোগিতা পেলে স্কুলের আকারে এই ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হবে।

ক্রাংসিং পাড়ার বাসিন্দা রেংমিটচ্যভাষী মাংপুং ম্রোর ছেলে সিংরাও ম্রো বলেন, “আমার বাবা রেংমিটচ্য-ভাষী হলেও এই ভাষা আমি ভালো করে জানি না। কতকগুলো সহজ শব্দ বলতে পারি। কিন্তু বাবা এখনও অনর্গলভাবে রেংমিচ্যভাষা বলতে পারেন। তারা জীবিত থাকতে আমাদের নতুন প্রজন্মদের শিখে রাখার জন্য আপাতত ৩২ জনকে ভাষা শিক্ষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে বয়স্করা মারা গেলে কারও মুখে হলেও এ ভাষা বেঁচে থাকে।

তিনি বলেন, আমাদের পাড়ায় ২২ পরিবারের মধ্যে এখনও রেংমিটচ্য ভাষার সাতটি পরিবার রয়েছে। কিন্তু এ ভাষায় কেউ কথা বলতে পারে না, কেউ জানেও না। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা এই রেংমিটচ্য ভাষার পরিবারের ছেলেমেয়েদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা শব্দগুলো শেখাব। উচ্চারণে কোনো ভুল হলে ঠিক করে দেওয়ার জন্য আমাদের বাবারা রয়েছেন। আমাদের পাড়ার বাইরে যে তিনজন রেংমিটচ্যভাষী রয়েছেন তাদেরকেও পাড়ায় নিয়ে আসব। এক সঙ্গে থেকে তারা যাতে নিয়মিত কথোপথন চালিয়ে যেতে পারেন।

সিংরাও ম্রো আরও বলেন, পাড়ার সবাই জুমচাষি হওয়ায় বেশিরভাগ লোকজন সারাদিন ব্যস্ত থাকবেন। তাই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেড় থেকে দুই ঘণ্টা করে পড়ানোর ব্যবস্থা থাকছে। পরে পাড়ার মাঝখানে অথবা পাশে কোনো একটা জায়গায় স্কুলটা করা হবে। তবে রেংমিটচ্য ভাষার পরিবারের বাইরে যেকোনো আগ্রহী ম্রোদের নেওয়া হবে, যাতে রেংমিটচ্য ভাষা সবার মুখে ছড়িয়ে থাকে।

ইয়াঙান ম্রোর লেখায় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় রেংমিটচ্য ভাষার শব্দভাণ্ডারের বই। রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন ম্রো জনগোষ্ঠীর হলেও তারা রেংমিটচ্য ও ম্রো উভয় ভাষাতেই কথা বলেন। তবে ম্রোদের মধ্যে শুধু রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারে এমন জীবিত রয়েছেন মাত্র ছয়জন, এখন যাদের অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব বয়সের।

বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বতর্মানে ছয়জন রেংমিটচ্য-ভাষী রয়েছেন। তারা হলেন- আলীকদম সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ক্রাংসিং পাড়ার বাসিন্দা মাংপুং ম্রো (৬৯), কুনরাও ম্রো (৭২) ও আরেকজন কুনরাও ম্রো (৬২) এবং নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৭)। অন্য দুজন হলেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবট পাড়ার রেংপুং ম্রো (৫৪) ও সাংপ্ল পাড়ার মাংওয়াই ম্রো (৬৫)। তার মধ্যে মাংপুং, রেংপুং ও মাঙওয়াই ম্রো আপন ভাই। জীবিত ছয়জনের মধ্যে দুজন নারী এবং চারজন পুরুষ।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে করা বাংলাদেশ নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৪টি ভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয়টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে রেংমিটচ্য একটি। ভাষা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রেংমিটচ্য ভাষার এ ছয়জন লোক মারা গেলে পৃথিবী থেকে আরেকটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ডেডিভ পিটারসন ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে বান্দরবান জেলায় আলীকদমে এসে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরু করেন। মূলত তিনিই প্রথম ম্রোদের মধ্যে রেংমিটচ্যভাষীদের খুঁজে বের করেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তার গবেষণায় মোট ২২ জন রেংমিটচ্যভাষী পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে মাত্র ছয়জন রেংমিটচ্যভাষী জীবিত রয়েছেন। ডেভিড পিটারসনের রেংমিটচ্য ভাষার কাজে গবেষণার সহযোগী ছিলেন ম্রো ভাষার লেখক ইয়াঙান ম্রো। সূত্র: বিডিনিউজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা - dainik shiksha শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি - dainik shiksha পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি - dainik shiksha দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস - dainik shiksha ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা - dainik shiksha রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না - dainik shiksha শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে - dainik shiksha ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030879974365234