যেভাবে পূরণ হবে বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার ঘাটতি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এখন দক্ষ জনশক্তির খুব অভাব। যদিও এ ঘটনা অতীতেও ছিল এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার, কভিডজনিত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি এবং আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘাটতি কমিয়ে আনা প্রয়োজন। শনিবার (৩০ অক্টোবর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায় দক্ষতার বিষয়ভিত্তিক ঘাটতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর যতটুকু জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা দরকার এবং যা থাকলে ওই বিষয়ের নির্দিষ্ট চাকরিতে যোগদানের ও চাকরি চালিয়ে যাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা থাকে, সেটা না থাকাকে বোঝায়। যখন কোম্পানিগুলো স্নাতকদের নিয়োগ দেয় তখন তারা যে যোগ্যতা নিয়ে আসেন এবং চাকরির জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন তার মধ্যে অমিল খুঁজে পায়। ফলে এ ব্যবধান কমানোর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ ও অর্থ ব্যয় হয় এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়।

এ ঘাটতি থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চাহিদামতো দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছে না। যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তাদের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যয়বহুল প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে নিতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ ব্যাহত হচ্ছে। চাকরির বাজারে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি থাকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব কর্মীর অনেকে আবার নতুন জায়গায় চলে যাচ্ছেন। এতে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও কর্মীদের ধরে রাখার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যবসা কিংবা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সবসময় একটি অস্বস্তিতে সময় পার করে।

২০১৭ সালের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) দেশের তৈরি পোশাক, নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, খাদ্যসহ নয়টি সেক্টরে দক্ষতা ঘাটতি নিয়ে এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কার্যত প্রতিটি সেক্টরেই দক্ষ কর্মী ও আধা দক্ষ কর্মীর স্বল্পতা রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রায় ৪০ শতাংশ চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তি না পাওয়ায় সেগুলো সবসময় খালি থাকে। আর যতটুকু পদ পূরণ হয়, তার মধ্যে ৬০ শতাংশ দক্ষ আর বাদবাকি অদক্ষ। গবেষণার প্রক্ষেপণ অনুসারে, ২০২১ সালে এ নয়টি সেক্টরের জন্য ৪০ লাখেরও বেশি কর্মীর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়বে। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৬ লাখের ওপর। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০২৫ সালে সাড়ে ৪ লাখ জনশক্তি প্রয়োজন হবে।

বিআইডিএসের গবেষণা মতে, প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার গ্র্যাজুয়েট তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় থেকে চাকরিতে প্রবেশ করেন কিন্তু তাদের বেশির ভাগই সরাসরি নিয়োগ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন নন। এর কারণ হিসেবে তারা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব এবং কর্মমুখী শিক্ষার ঘাটতি বলে উল্লেখ করেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কারিকুলাম উন্নয়ন, ইন্ডাস্ট্রি-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় যোগাযোগ এবং আইটি দক্ষতা উনয়নবিষয়ক প্রোগ্রামের সুপারিশ করেছেন। এখানে শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু তথ্যপ্রযুক্তির বিষয় উঠে এলেও মোটাদাগে সব বিষয়েই এ সমস্যা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

সম্প্রতি কোর্সএরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের স্কিল-গ্যাপ নিয়ে ‘আনবাউন্ডেড ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কোর্সএরার মতে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রোগ্রামিং এবং ডাটা ম্যানেজমেন্ট দক্ষতায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাদের মতে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষতার ঘাটতি মেটাতে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে প্রায় ৪৮ দিন, বা গড়ে একটি সেমিস্টারেরও কম সময় লাগবে। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের জন্য এ ব্যবধান ২৮ দিন এবং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের জন্য ১৯ দিন।

স্পষ্টতই কোম্পানিগুলো দক্ষতার ঘাটতিতে প্রভাবিত হয়। তারা সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ চায়। কিন্তু দক্ষ লোকের অভাব কোম্পানির জন্য একটি ব্যয়বহুল সমস্যা তৈরি করছে এবং জনশক্তির মোট সরবরাহ শৃঙ্খল প্রভাবিত করছে। কোর্সএরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছে চাকরিবাজারের জন্য কীভাবে তাদের গ্র্যাজুয়েটদের প্রস্তুত করেন সেটি সম্পর্কে জানতে চায়। অধ্যাপকরা শিক্ষার্থীদের শুরু থেকে প্রস্তুত করার জন্য যে পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করেন তা বর্ণনা করেছেন।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক হেলথ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের বাস্তবভিত্তিক (অথেনটিক) অ্যাসাইনমেন্ট প্রদান করে। ক্লাসের এ অ্যাসাইনমেন্টগুলোয় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে এমন সমস্যা সমাধান করতে দেয়া হয়, যে কাজগুলো একজন স্নাতককে তার চাকরিতে করতে বলা হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি কেসস্টাডি, কোনো একটি নির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ে গবেষণা অথবা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাকর্ম পর্যালোচনা প্রস্তুত করা। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বটি আয়ত্ত করেন এবং যখন তারা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করেন, এ অভিজ্ঞতা তাদের কাজের জন্য প্রস্তুত করে তোলে।

বুদাপেস্ট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সব শিক্ষার্থীকে প্রত্যেক সেমিস্টারের শুরুতে টিম বিল্ডিং, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীল লেখা, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে সপ্তাহব্যাপী কর্মশালায় যোগ দিতে হয়। এই বাধ্যতামূলক কর্মশালা বা সংক্ষিপ্ত কোর্সগুলো তাদের একটি সফল ক্যারিয়ারের জন্য প্রয়োজনীয় সফট স্কিল অর্জনে সাহায্য করে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা কর্মশালার ব্যবস্থা করে। নবীন শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ, টিম বিল্ডিংয়ের প্রশিক্ষণ পান এবং সিনিয়রদের সিভি রাইটিং ও জব ইন্টারভিউ কর্মশালায় যোগ দিতে হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীরা একাধিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান।

দক্ষতার ব্যবধান কোম্পানিগুলোকে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বাইরে আরো প্রশিক্ষণ আয়োজনের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য করে। দক্ষতার এ ব্যবধান দূর করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্তর সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে কারিকুলামের মান উন্নয়ন, স্কলারশিপ কিংবা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা ইত্যাদি খাতে তারা কিছু অর্থ ব্যয় করতে পারে। এতে অনেক শিক্ষার্থী বাস্তব এবং কর্মমুখী জ্ঞান লাভ করবে। এই ব্যয়িত অর্থ একেবারে আনকোরা প্রার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয়িত অর্থের চেয়ে কম হবে। শিল্প প্রস্তুত গ্র্যাজুয়েট নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজারের চাহিদার সঙ্গে পাঠ্যক্রম সাজাতে পারে। দক্ষতার ব্যবধান কমাতে এবং যোগ্য স্নাতকদের সরবরাহ বজায় রাখার জন্য এটি একটি ভালো সমাধান বলে মনে হচ্ছে।

বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ঘাটতি মোকাবেলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্পের মাঝে নিবিড় যোগাযোগ ও সহযোগিতার বিকল্প নেই। যেহেতু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জনশক্তি সরবরাহের কাজ করছে, সুতরাং এখান থেকেই দক্ষতার ঘাটতি মেটাতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চাহিদার ব্যাপারটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দিতে পারে, তাদের কী ধরনের জনশক্তি প্রয়োজন, কোন কোন প্রশিক্ষণ দরকার, ফলে তাদের পক্ষে কারিকুলামে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা সম্ভব। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরো কর্মোপযোগী করে তোলা যাবে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষাদানের পরও তার শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। এজন্য তাদের যেসব প্রয়োজনীয় দক্ষতা দরকার, যেগুলোর চর্চা করতে হবে। ক্যারিয়ার সেন্টার গঠন করে সেখানে গ্র্যাজুয়েটদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের উল্লিখিত ১০টি সফট স্কিল বা গ্র্যাজুয়েট স্কিল যাতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আয়ত্ত করতে পারেন সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য একটা সংবেদনশীল এবং শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দরকার। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের অজান্তেই এসব গ্র্যাজুয়েট স্কিল আয়ত্ত করতে পারেন। এসব কাজে তারা নিয়োজিত থাকায় তাদের দৈহিক সুস্থতা ও মানসিক বিকাশ ঘটবে।

লেখক : ড. চৌধুরী মোহাম্মদ মোকাম্মেল, অধ্যাপক, সিএসই ও অতিরিক্ত পরিচালক (আইকিউএসি), মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006087064743042