রবীন্দ্রনাথ জন্মদিনকে যেভাবে দেখতেন

ইমরান ইমন |

রবীন্দ্রজয়ন্তী বা পঁচিশে বৈশাখ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক উৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই উৎসব হয়। এ বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হচ্ছে। 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্য এবং বাংলাদেশে ও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব উদযাপন করা হয়। বহির্বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালিরাও এই উৎসব উদযাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গে দিনটি ছুটির দিন।

ইমরান ইমন

রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হলো রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়, রবীন্দ্ররচনাপাঠ, আলোচনাসভার আয়োজন ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলোতে এই সময় বিশেষ জনসমাগম দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলো আয়োজিত হয় কলকাতায় অবস্থিত কবির জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রসদন এবং শান্তিনিকেতনে।

বাংলাদেশে সর্বত্র ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয়। এ ছাড়া শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘিরেও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করা হতো। ঘটা করে, সাড়ম্বরে এ দিবসটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, মন-মানসিকতা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের গৌরবোজ্জ্বল অবদানের প্রতি ঋণ স্বীকার করে। কিন্ত এ রবীন্দ্রজয়ন্তী সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সুমহান ইতিহাস। যা আমরা অনেকেই জানি না। জেনে নেয়া যাক, রবীন্দ্রজয়ন্তীর ইতিহাস এবং রবীন্দ্রনাথ তার রবীন্দ্রজয়ন্তীকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ-পচিঁশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।’ এইটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নিজের জন্মদিন নিয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। কিন্তু এই ধারণা ভেঙে যাবে যদুনাথ সরকারকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে। কবি লিখেছিলেন, ‘এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সংকোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।’

রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় নিজের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তাই ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপিত হয়। তারপরও কবির জন্মদিন আরো ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলের আড়ালে ছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তার বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন কবি।

কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদযাপিত হয় ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে, কবির তখন ২৬ বছর বয়স। কবির ভাগনি সরলা দেবীর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইটিতে লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন–পাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তার জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।’ কিন্তু প্রকৃত অর্থে ও সর্বজনীনভাবে প্রথম রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয় ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে, শান্তিনিকেতনে। কবি সেবার ঊনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে পা দিয়েছেন। বিপুল উৎসাহে আশ্রমিকরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করেছিলেন ‘আত্মীয়দের উৎসব’ নামে।

রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার উদযাপিত হয় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে। সে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১ তে পা দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণীজন। তাদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

বেদ-উপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিরো। কবির মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেলেও, তা প্রকাশ পেয়েছিলো নেপালচন্দ্র রায়ের ভাষণে। নেপালচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও না’। সত্যি কবি ঈশ্বর হতে চাননি, তিনি তাই লিখেছিলেন—
 ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে
সবার পিছে, সবার নিচে, সব-হারাদের মাঝে।’

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ। মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছিলো কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তী, যা আজও বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর মুখ্য উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোম। উদযাপন কমিটিতে ছিলো চাঁদের হাট। কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, প্রশান্ত মহলানবিশ, সিভি রমণ, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা।

কবির সংবর্ধনা উপলক্ষে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিলো, বাংলা এবং ইংরেজিতে। ইংরেজি বইটির নামকরণ করেন রঁমা রঁলা। তিনি নাম দেন, ‘Golden Book of Tagore’। বইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ আইনস্টাইন, ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকি’র মতো বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিরা।

শুধু বৈশাখে নয়, সে বছর ভরাশীতে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে, ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর কলকাতায় ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ উদযাপিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে ও টাউনহলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। টাউনহলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি ও লেখার পাণ্ডুলিপি প্রদর্শিত হয়েছিল। ইডেন গার্ডেন প্রাঙ্গণে যাত্রা, কীর্তন, জারি গান, কথকতা, রায়বেশে, দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছিলো।

পঁচিশে বৈশাখ ১৯৪১ কবির জীবদ্দশার শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে শান্তিনিকেতনে উদযাপিত হয় বিশ্বকবির জীবনের শেষ শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী। শান্তিনিকেতনের ‘উদয়নে’ বসে জীবনের শেষ জন্মদিন উপলক্ষে কবি লিখেছিলেন কয়েকটি লাইন, যা ছিলো দার্শনিক কবির জীবনচর্যার নির্যাস-
 ‘আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।’

রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য জীবদ্দশাতেই অপমানিত হয়েছিলেন বিশ্বকবি। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় পরিষদ যখন রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করে, তখন তার বিরুদ্ধে কলকাতার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তারা রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনের বিরুদ্ধে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেন এবং একটি লিফলেট কবিকেও পাঠিয়ে দেন।

শোকাহত কবি ৪ মে (১৯১১) চিঠি লেখেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আজ আমার পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হইবার মুখে এই আর একটি নিন্দা আমার জন্মদিনের উপহার রূপে লাভ করিলাম এই যে, আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি। এই নিন্দাটিকেও নতশিরে গ্রহণ করিয়া আমার একপঞ্চাশ বৎসরের জীবনকে আরম্ভ করিলাম–আপনারা আশীর্বাদ করিবেন সকল অপমান সার্থক হয় যেন’।

কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখতে খাতা ভরে যাবে, কলমের কালি নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু তাকে নিয়ে লেখা শেষ হবে না। জীবনের নানা দিকে তার বিস্তার ও বাঁক।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051620006561279