মার্চ মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। এই মাসেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম। ভাষা আন্দোলনও শুরু হয় মার্চে। অন্যদিকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয় এ মাসেই। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুও তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন এ মাসে। অন্য কথায়, বাঙালির জাতীয় জীবনে মার্চ মাস একটি অতুলনীয় ও অবিস্মরণীয় মাস।
আবার এবারের মার্চ মাসে রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তাহলো রমজানের সিয়াম সাধনা। স্বাধীনতা দিবসের দু'দিন আগ থেকেই সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জাতি দীর্ঘ এক মাসের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারিভাবে মাসব্যাপী ছুটি বা স্বল্প সময়কালীন অফিস কার্যক্রম চালু রাখলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রমজানের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে অল্পদিনের। এটি নিয়ে নানা মহলে গুঞ্জন রয়েছে বিভিন্নভাবে। কেউ কেউ মনে করেন একই শিক্ষাব্যবস্থায় দু'ধরণের সিদ্ধান্ত ভুক্তভোগী শিক্ষকদের মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। আবার কেউ কেউ এটিকে শিশু শিক্ষার জন্য ভালো উদ্যোগ বলেও মন্তব্য করেছেন।
তবে রমজান মাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলে ভালো বৈ খারাপ কিছু হয় না তা আমরা অনেকটাই নিশ্চিত। কারণ, এ মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নানাবিধ সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর। ইসলামী কুইজ প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কুরআন শিক্ষার আসর, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের আমেজ তৈরি করে, যা সুশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরবী শিক্ষার কোর্স চালু করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রাথমিকের শিশুরা পবিত্র রমজান মাসে কায়দা, আমপারাসহ পবিত্র কোরআন শরীফ শুদ্ধভাবে শেখার জন্য মসজিদ, মক্তব বা নিজ গৃহে শিক্ষক/হুজুর রেখে পড়াশোনা করে থাকে। ইসলাম শিক্ষার শিক্ষকগণ মাসব্যাপী আরবী শেখার বিশেষ কোর্স চালু করে অতিরিক্ত অর্থও উপার্জন করে থাকেন এ মাসেই।
যেহেতু এবারের রমজান মাস এসেছে স্বাধীনতার মাস মার্চে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এ মাস। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রমজান মাস যেমন সভ্য মানব সম্পদ তৈরিতে ভূমিকা রাখে, স্বাধীনতার মাসে আগত রমজান মাসও শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রদান করে থাকে। স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিষ্ঠুর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো আমাদের তরতাজা বাঙ্গালী সম্প্রদায়। অর্জিত হয়েছিলো বাংলাদেশের পবিত্র স্বাধীনতা। এ থেকে পেয়েছি আমরা ত্যাগের মহিমা, শিখেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার তীব্র বাসনা। রমজান মাসও আমাদের যে বার্তা দেয় তাহলো আত্মত্যাগ। কারণ আত্মত্যাগেই রয়েছে আত্মতুষ্টি এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা।
প্রতি বছর ২৬ তারিখে উদযাপিত হয় দেশব্যাপী স্বাধীনতা দিবস। করপোরেট অফিস, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক অফিসগুলোতে এ দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে কিছুটা শৈথিল্য থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি পালন করা হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে এবং স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও অভিভাবকসহ সকল ছাত্রছাত্রী এবং কর্তৃপক্ষ অতি ভাবগাম্ভীর্যের সাথে এদিনটি উদযাপন করে থাকেন। কিন্ত সিয়াম সাধনার এ মাসে এবার দিবসটি উদযাপন করতে অনেক কিছুতেই ব্যাপক ছাড় দিতে হয়েছে। যেমন- নাচ-গান, উঁচু আওয়াজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বাদ্য-বাজনা ইত্যাদি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে অধিকাংশ মুসলিমই তাদের ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন। অমুসলিম সম্প্রদায়ও এ মাসের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল থেকে অধর্মীয় কোন কাজে লিপ্ত হয় না। এটিই মূলত সম্প্রীতি ও অন্য ধর্মের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ। আর এজন্যই এবারের স্বাধীনতা ও রমজান পালন অনেকাংশেই ব্যতিক্রম এবং তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক। তাই স্বাধীনতার মাসে রমজানের আগমন ঘটায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী করণীয় রয়েছে:
১। সিয়াম সাধনা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দোয়া করা এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা।
২। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য কুরআন শিক্ষার বিশেষ কোর্স চালু করা এবং অমুসলিমদের জন্য নৈতিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা।
৩। শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময়োপযোগী আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা।
৪। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দেশের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসার কারণে যে সকল মহান প্রাণ আত্মাহুতি দিয়েছেন বা যারা অর্থ ও বুদ্ধি দিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন, তাদের কথা স্মরণ করে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি, হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতাসহ অন্যান্য চেতনাসম্মৃদ্ধ কার্যক্রম করা।
৫। রমাজানের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে শিক্ষার্থীদের মনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, সিয়াম সাধনার বিধান পালন ও নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার শিক্ষা দিবেন সম্মানিত শিক্ষকগণ।
৬। রমজান মাস মূলত ধৈর্য্য, সহানুভূতি, সততা ও সম্প্রীতিসহ মানবতাবোধ জাগ্রত করার মাস। আর স্বাধীনতা আন্দোলনের শিক্ষাও তেমিনই। সুতরাং এ মাসে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে মানবতার শিক্ষা দিয়ে গরীব-দু:খীদের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত করবেন।
৭। স্বাধীনতার মূল শিক্ষা হলো দেশ প্রেম। পরাধীনতার তীব্র যন্ত্রণা ও অত্যাচার-অনাচারের গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করতে সর্বসাধারণ মানুষ সেদিন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেটি ছিলো স্বদেশের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের মনে স্বাধীন দেশের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষা করতে শিক্ষকদেরকে ভূমিকা রাখতে হবে।
৮। রমজান মাস একটি পবিত্র মাস। এ মাসে পাপাচার-দুরাচার, অসভ্যতা-অশালীনতা, নগ্নতা-বেহায়াপনা, ঝগড়া-বিবাদ ও অহেতুক কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার জন্য মুসলিম সম্প্রদায় সিয়াম সাধনা করে থাকেন। আমাদের স্বাধীনতার মহান শিক্ষাও তাই। বাহুল্য কাজ-কর্ম ও অনৈতিক আচরণের জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি, বরং স্বাধীন হয়েছে দুর্নীতি ও অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদেরকে এ শিক্ষায় উজ্জীবিত করে একটি সভ্য জাতি বিনির্মাণে সচেষ্ট থাকবেন।
৯। যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে একতা, নিষ্ঠতা, একাগ্রতা ও অসাম্প্রদায়িক মন-মানসিকতা তৈরিতে ব্যাপক অবদান রাখতে পারেন। রমজানের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে আদর্শ শিক্ষার্থীদের মনে স্বাধীনতার প্রকৃত জ্ঞান প্রদান করতে হবে।
১০। স্বাধীনতার ছড়া, সঙ্গীত, প্রবন্ধ লিখন চর্চা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে সৃষ্টিশীল শিক্ষার প্রতি অনুপ্রেরণা জাগানোর কাজ শিক্ষকগণই করতে পারেন। ঠিক তদ্রুপ রমজানের সিয়াম ব্রত পালনের মাধ্যমে মুসলিম শিক্ষার্থীদের আবেগ ও অনুভূতিতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অতএব, স্বাধীনতার মাসে এবার রমজানের আগমন আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদ এবং শিক্ষকদের জন্যও এটি একটি সুযোগ। কারণ স্বাধীনতা ও রমজানের শিক্ষাতথ্য গ্রহণ করে তারা শিক্ষার্থীদেরকে সুপথে এনে আদর্শ জাতি গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন। শিক্ষকগণ জাতির বিবেক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কর্ণধার। শিক্ষকদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধের কারণে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে স্বাধীনতা ও সিয়াম সাধনার অমীয় বাণী আন্তরিকভাবে হৃদয়োঙ্গম করে থাকে। তাই আসুন আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে রমজান ও স্বাধীনতার শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে সহযোগিতা করে একটি আদর্শ সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধ ভিত্তিক জাতি গঠনে সচেষ্ট হই।