রমজান মানবজীবনকে শোধরানোর মাস। রমজান আমাদের জীবনের সব পাপ পঙ্কিলতা জ্বালিয়ে নিযে আসে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের বার্তা। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন ইমান ও এখলাছের সঙ্গে যারা রোজা রাখেন। মহান আল্লাহ তাদের অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেন। মাহে রমজান পবিত্র কোরান নাজিলের মাস। রমজান আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে মহান আল্লাহর দয়া অর্জনের সুযোগ দিতে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের এই পবিত্র মাস আমাদের মাঝে সব হানাহানি, ভোগ-বিলাস, অপচয়, অন্যায়, অবিচার সংযমসহ সত্য ও ন্যায়ের পথে পথ চলতে শেখায়। এ মাসে সব অকল্যাণকর কাজ থেকে দূরে রেখে পরবর্তী জীবনে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ প্রশিক্ষণ মানবজীবনে বিশাল পরিবর্তন এনে থাকে। রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসার বন্ধন, ধনী-দরিদ্রের আত্মার বন্ধন কাছাকাছি চলে আসে।
রমজান মাস আমাদের জীবনের শিখন ঘাটতি পূরণের মাস। এই মাসে প্রায় সব মুসলমান তাদের সারা বছরের খারাপ কাজগুলোর ঘাটতি পূরণ করার জন্য ভালো কাজ করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন।
আজকের শিক্ষার্থী আগামী প্রজন্মের হৃৎপিণ্ড। তাদের সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারলে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। সুনাগরিকদের মাধ্যমে তৈরি হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। এই রমজান মাসের শিক্ষাই পারে আগামী প্রজন্মকে অনেকটা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। শিক্ষায় শিখন ঘাটতি অতি আদি বিষয়। এ শিখন ঘাটতি দূর করার বাস্তবভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ বর্তমান সময়ে দৃশ্যমান নয়।
আমাদের সময়ে শিক্ষার্থীদের ছুটির শেষে পড়া শিখে বাড়ি যেতে হতো। বর্তমানে নিরাময়মূলক ক্লাসের জন্য ছুটির পূর্বে ১৫ মিনিট সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের শ্রেণির কার্যক্রম ২৫, ৩০ বা ৪০ মিনিট। এই স্বল্প সময়ের কার্যক্রমে শিখন ঘাটতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এজন্য শ্রেণির কার্যক্রম এক ঘণ্টা করা প্রয়োজন। প্রতিদিন চারটা পিরিয়ডের বেশি হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ওপর মানসিক চাপ পড়বে। শিক্ষার্থীর ধারণ ক্ষমতার বেশি শ্রেণির কার্যক্রম হলে শিখন ঘাটতি দূর হওয়ার পরিবর্তে শিখন ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে। একটা প্রবাদ আছে ‘অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর’। শিখন ঘাটতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সংকট। এই সংকট দূরীকরণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষক নিয়োগে প্যানেল তৈরি করা। যাতে শিক্ষক পদে শূন্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়।
রমজান মাসে শিখন ঘাটতি দূর করার নামে রোজায় স্কুল খোলার কার্যক্রম কতোটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে তা বাস্তবতার নিরিখে পর্যালোচনা করা করা হলো।
প্রথমে আসা যাক শিক্ষকদের প্রসঙ্গে, ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমপক্ষে ছয়টা বা তার বেশি শ্রেণির কার্যক্রম করতে হয়। রোজা রেখে একটা বা দুইটা শ্রেণির কার্যক্রম যথাযথভাবে করলেও পরবর্তী কার্যক্রমগুলো দায়সারা বা যেনতেনভাবে শেষ করে থাকেন। তাদের এ পাঠদানের মাধ্যমেও শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। রোজা রেখে ক্লান্তি ও তৃষ্ণা এসে শিক্ষকদের দেহে ভর করে। এতে তারা পাঠদানের স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শিক্ষার্থীদের হইচই চিল্লা-চিল্লিতে শিক্ষকের মানসিক প্রশান্তির পরিবর্তে অশান্তি ভোগ করতে হয়।
এবার শিক্ষার্থীদের প্রসঙ্গে যাক। আমাদের দেশের জনগণ অতি ধর্মপরায়ন। প্রত্যেক ধর্মের জনগণ তাদের ধর্ম, কর্ম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভের চেষ্টা করে থাকেন। বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ জনগণ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। আমাদের ধর্মের অন্যতম ইবাদতের মাস রমজান। এই মাসে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে খুব সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে ধর্মপরায়ন মুসলমানগণ রোজা পালনের পাশাপাশি জামাতে মসজিদে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দান খয়রাত গরিব মানুষ ও পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার বিতরণসহ নানা ভালো কাজ করে থাকেন।
বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও কোরআন শিক্ষা, রোজা রেখে থাকেন। মসজিদে জামাতে নামাজ পড়াসহ নানা ধরনের ভালো কাজ করে থাকেন। রোজার মাসে বিদ্যালয় খোলা রাখার হালচাল দেখার অভিপ্রায়ে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করে যে চিত্র দেখা গেলো তা দেখানো হলো। গত ১২ মার্চে বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের উপস্থিতি ২০ শতাংশের নিচে। ১৩ ও ১৪ মার্চ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিকের ১টি স্কুলে মোট ১ হাজার ৩৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিতি ছিলো, যথাক্রমে ২৮০ ও ২৫০ জন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে উপস্থিত ছিলেন ৭৯৭ জন এবং ৩ মার্চ উপস্থিত ছিলেন ৬৩৮ জন।
উপস্থিতি কম প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, মৌচাক, খিলগাঁও, তালতলাসহ বড় বড় মার্কেটে ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণির বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীরা রোজার মাসে কাজ করে থাকেন। তাদের উপস্থিতি মার্কেটগুলোতে গেলেই পাওয়া যাবে। আরো ১১টি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৩ ও ১৪ মার্চের উপস্থিতির হার যথাক্রমে: ৪৫ ও ৪০ শতাংশ, ৪০ ও ৫০ শতাংশ, ৬০ ও ৭০ শতাংশ, ৪৫ ও ৪০ শতাংশ, ৪০ ও ৪২ শতাংশ, ৪৩ ও ৪১ শতাংশ, ৪৪ ও ৪৯ শতাংশ, ৪৭ ও ৪৩ শতাং, ৪১ ও ৪২ শতাংশ, ৫২ ও ৪৭ শতাংশ এবং ৪৩ ও ৪৪ শতাংশ।
প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেলো, এই উপস্থিত শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে কর্মকালীন পুরো সময়ের নয়। বিরতির সময়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা দেয়াল টপকিয়ে বা বিভিন্ন উপায়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে থাকেন। বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করে দেখা গেলো, প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর মাঝেও রোজা রাখার প্রবণতা দৃশ্যমান। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। তৃতীয় থেকে ওপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে রোজা রাখার প্রবনতা প্রায় ৯৫ শতাংশ। রোজা রেখে এবাদত করার কারণে বিদ্যালয় খোলা থাকার ফলে তাদের শারীরিক মানসিক চাপ সৃষ্টি হওয়ায় উপস্থিতির হার খুবই কম। এতে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। এই চিত্র শুধু ঢাকা শহরের। ঢাকা শহরের বাহিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা রোজা বেশি রেখে থাকেন। এতে মেয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। শিখন ঘাটতি দূরীকরণে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিশ্চিত না করে রোজার মাসে বিদ্যালয়ে খোলা রাখা কতোটা যৌক্তিক? নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সংশ্লিষ্টরা রোজার মাসে বিদ্যালয় পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা জরুরি। রোজা থেকে শিক্ষকদের মতো ছয়-সাতটা শ্রেণির কার্যক্রমের পরিবর্তে কমপক্ষে দুই একটা ক্লাস করে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেয়ার সবিনয় নিবেদন রইলো।
শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য শিক্ষক ঘাটতি শুণ্যে নামিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি পিরিয়ডের সংখ্যা কমিয়ে সময় বৃদ্ধি করতে হবে। জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত পুরো শ্রেণির কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। মূল্যায়ন, পরীক্ষা ও ভর্তির কার্যক্রম ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। আর যেনো না হয় রোজার মাসে শিখন ঘাটতির নামে বিদ্যালয়ে খোলা রাখার কার্যক্রম। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাস্তবতার আলোকে ব্যবস্থা নেবেন। এই প্রত্যাশায়।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ