রমজানে স্কুলে পাঠদান : শিখন ঘাটতি পূরণ হবে

এম এ আলিম খান |

২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকারকে অত্যন্ত আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো ৪ অর্থাৎ মানসম্মত শিক্ষা। এই গোল বা লক্ষ্যার্জন ছাড়া অন্য কোনো গোল অর্জন সম্ভব নয়। আমরা কয়েক বছর ধরে দেখেছি, শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান অর্জিত হচ্ছে না। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে দুইবারে দেশে প্রায় দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ কারণে একদিকে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে; অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ঝরে পড়েছে।

‘শিশুরা কি সত্যিই শিখছে?’ শীর্ষক বিষয়ে ৩০ মার্চ জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ২০২০ মার্চ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং আবার ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শুধু শিক্ষাই ব্যাহত হয়নি, এ কারণে তাদের পড়তে ও গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতার ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়েছে। যদিও এই ঘাটতি মহামারির আগেও ছিল।’

ইউনিসেফের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশের পড়তে পারার এবং মাত্র ১৮ শতাংশের গুনতে পারার প্রাথমিক দক্ষতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অবস্থা আরও খারাপ। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, মহামারির আগেও বাংলাদেশের শিশুরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিল। কোভিডে বাংলাদেশের শিশুদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য প্রতিকারমূলক শিক্ষাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে তা পরবর্তী প্রজন্মের শিশু ও তাদের পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।

এ চিত্র শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেরও। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে কয়েকটি দেশের শিশুদের ঝরে পড়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। লাইবেরিয়ায় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে স্কুলগুলো আবার খুলে দিলে দেখা যায়, সরকারি স্কুলের ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ফিরে আসেনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে সাড়ে সাত লাখ হয়েছে। উগান্ডায় ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে স্কুল আবার খুললে দেখা যায়, ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে ফেরেনি। কেনিয়ায় ১০-১৯ বছর বয়সী চার হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, স্কুল আবার খোলার পর ১৬ শতাংশ মেয়ে ও ৮ শতাংশ ছেলেশিক্ষার্থী স্কুলে ফেরেনি।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, শিশুরা যখন তাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি হয়। যখন তারা একবারেই যোগাযোগ করতে পারে না, তখন তাদের শেখার ক্ষতি স্থায়ী হতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি, শিশুদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের শেখার অবস্থা কী, তা মূল্যায়ন করা। তারা যা হারিয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় নিবিড় সহায়তা প্রদান এবং শিক্ষকেরা যাতে তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার উপকরণ পান, তা নিশ্চিত করা। এগুলো করতে না পারলে অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি হবে।

যখন একটানা ১৮ মাস স্কুল বন্ধ ছিল, তখন শেষের দিকে এসে ইউনিসেফসহ শিক্ষাবিদেরা সরকারকে স্কুল খোলার বিষয়টি বারবার বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছিল। সরকার সবকিছু বিবেচনা করে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খুলে দেয়। কোভিড পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বুঝে আবার ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো স্কুল বন্ধ করে দেয়। একমাস পর টিকাদান সাপেক্ষে ২২ ফেব্রুয়ারি নিম্ন-মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৫ মার্চ থেকে প্রাথমিকসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে।

১৫ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর, ২২ মার্চ যখন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণকল্পে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি পাঠদান বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়, তারপর থেকে শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাসে শ্রেণি পাঠদান নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা, যা টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা–সমালোচনা পিছিয়ে নেই। জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষককে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্যের জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শোকজ করেছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমাজের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রমজান মাসে শ্রেণি পাঠদান বন্ধ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিটও করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে আবার ২০ এপ্রিল পর্যন্ত শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। 

রমজান মাসে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ১৩ দিন পাঠদান হবে। ইতিমধ্যে মাধ্যমিক ও কলেজপর্যায়ে রমজানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ১০-৪০% কমে গেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মূলত এসএসসি পরীক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে জোর দেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায় শ্রেণিকক্ষে তাবাই বেশি অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ আবার স্কুল নয়. কোচিং এর পিছনে ছুঁটছে। স্কুল বাদ দিয়ে কোচিং করছে। রমজানে শিক্ষার্থীরা যদি স্কুলে নিয়মিত না আসে এবং শিক্ষকেরা যদি আন্তরিকভাবে পাঠদান না করেন, তাহলে যে উদ্দেশ্যে নিয়ে রমজান মাসে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করা হচ্ছে তা কতটা পূরণ হবে এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। একদিকে মানসম্মত শিক্ষার অভাব এবং অন্যদিকে কোভিডের শিখন ঘাটতি পূরণ শিক্ষাবিদদের চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। কারণ এসডিজি’র ৪ নম্বর গোল হল মানসম্মত শিক্ষা, যা ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিকে ২০২৩ সাল থেকে যদি স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন করা হয় তাহলে কোভিডের শিখন ঘাটতি পূরণ এবং মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে আরও সময় লাগবে। 

লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশের সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031390190124512