রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের চার বছরেও আলোর মুখ দেখেনি নিরাপদ সড়ক আইন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চার বছর আগে এই দিনে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও মীম। সেই ঘটনার সূত্র ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে লাখো শিক্ষার্থী। আন্দোলনের মুখে পাস করা হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’। তবে এই আইন এখনো শতভাগ আলোর মুখ দেখেনি।

আইন কার্যকরের আগেই শাস্তি, কারাদণ্ড বিধান কমিয়ে এবং অজামিনযোগ্য অপরাধকে জামিনযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটির সংশোধন আটকে থাকায় তৈরি হচ্ছে না বিধিমালা। যদিও সংসদে পাস হওয়ার পর ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এর গেজেট জারি করা হয়। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে সরকার এ আইন কার্যকরের ঘোষণা দেয়।  

মোট ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি ধারায় পরিবর্তন এনে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়। পরে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিতে গত বছরের মে মাসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে খসড়াটি তোলা হয়। বর্তমানে সংশোধিত খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি পাওয়ার পর খসড়াটি সড়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হবে। সেখান থেকে বিল আকারে সংসদে উপস্থাপন করা হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ  বলেন, সরকার চাইলে সাত দিনের মধ্যে আইনটি সংশোধন ও কার্যকর করা সম্ভব। কিন্তু সরকার সেটা চায় না বলেই বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, একটি আইন কার্যকরের জন্য বিধিমালা খুবই জরুরি। বিধিমালায় আইনের বিস্তারিত খুঁটিনাটি বিষয়গুলো উল্লেখ থাকে। সড়ক পরিবহন আইন এখনো কার্যকর হয়নি। এটা এখনো কাগজে-কলমের আইন।

সংশোধনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘আইনটি সংশোধনের সঙ্গে একাধিক মন্ত্রণালয় জড়িত। আর কত সময় লাগবে সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ’

কেমন হচ্ছে আইনের সংশোধন

বর্তমান আইনের ১০৫ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতর আহত বা নিহত হলে দায়ী ব্যক্তির সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে আহতদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। আর নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পাঁচ লাখের পরিবর্তে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। তবে ভুক্তভোগীকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবেন।

সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবে চালকের সহযোগীও শিথিল যোগ্যতায় চালক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এ আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি ধারায় বিদ্যমান কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড কমানো হচ্ছে। আর ভারী ও মাঝারি মোটরযানের সংজ্ঞাসহ আটটি বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নতুন কয়েকটি ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো গৃহীত হলে নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি বা চালকের অবহেলার কারণে দুর্ঘটনায় শুধু আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলে চালককে দায়ী করে বিচার করা যাবে না।

সংশোধনের খসড়া অনুযায়ী, ওভারলোডিং (গাড়ি মাত্রাতিরিক্ত বোঝাই) এবং মোটরযানের আকার পরিবর্তনের অপরাধকে জামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যা বর্তমানে অজামিনযোগ্য। অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেই একজন চালক নিবন্ধিত তিন চাকার গাড়ি চালাতে পারবেন। আবার একজন সহকারী বা সুপারভাইজার ১০ বছর কাজ করে যদি দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং ড্রাইভিং সক্ষমতা বোর্ডে পাস করেন, তাঁর ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কয়েকটি শর্ত মানা প্রয়োজন হবে না।

এত দিন যেখানে নকল, ভুয়া বা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করলে সর্বনিম্ন ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ছিল, সেখানে সংশোধনীতে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাহার করার পরও ওই ব্যক্তি গাড়ি চালালে ২৫ হাজারের পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা ও কারাদণ্ড অর্ধেক করা হচ্ছে।

চলমান আইন অনুযায়ী, অনির্ধারিত জায়গায় গাড়ি পার্ক করলে বা যাত্রী ওঠানামা করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। সেখানে প্রস্তাব অনুযায়ী, এই অপরাধের জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।

৫৭ ধারায় ভুক্তভোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দিতে আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে। ওই তহবিলের উৎস হিসেবে নিয়ন্ত্রণহীন চালক ও মোটরযান মালিকের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানার কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সংশোধনের প্রস্তাবে বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে সরকারি তহবিল বা পরিবহন সংগঠনগুলোর দেওয়া চাঁদার ওপরই নির্ভর করতে হবে। ২৫(২) ধারা অনুযায়ী, অনুপযোগী কোনো মোটরযানের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সঙ্গে কোনো কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রস্তাবে এটি বাদ দিতে বলা হয়েছে।

বর্তমানে আইনের ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারা অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনটি সংশোধন করা হলে ৮৪ ও ৯৮ ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। ৮৪ নম্বর ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ ছাড়া খসড়া অনুযায়ী, ৯৮ ধারাকে আপসযোগ্য বলা হয়েছে। আগে ১৪ আসন পর্যন্ত গাড়ি ছিল মাইক্রোবাস শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, এখন তা করার প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ আসন পর্যন্ত।

সংশোধনের আগেই শাস্তি কমেছে

আইনটির সংশোধনের প্রস্তাব পাস না হলেও মাঠ পর্যায়ে খসড়া অনুযায়ী শাস্তি কমানো হয়েছে বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা খেয়াল করে দেখেছি, বিআরটিএ বর্তমান আইনে অর্থদণ্ড দিচ্ছে না। এই ঈদে বিআরটিএকে আমরা চারটি ঘটনা প্রসঙ্গে অভিযোগ জানাই। বিআরটিএ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে। তবে দেখা গেল, বর্তমান আইনে যেখানে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা, সেখানে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। খসড়ায় শাস্তি কমিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে। ’

কতটা নিরাপদ হলো সড়ক

আইন করে সড়ক কতটা নিরাপদ হলো—এমন প্রশ্নে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আইনটি কতটা কার্যকর, সেটা বোঝা যেত এই আইনের বাস্তবায়ন হলে। এর আগেই যখন সংশোধন হচ্ছে তখন সেই সংশোধনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে।

‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলছেন, আইনে কিছু জিনিস আরো সুস্পষ্ট করা দরকার। যেমন : আইনে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালালে জরিমানা করা হবে। কিন্তু অতিরিক্ত গতি কত সেটা উল্লেখ নেই। আর শাস্তি কমানো, অজামিনযোগ্য অপরাধকে জামিনযোগ্য করা হলে সেটা মানা হবে না।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রদের সেই আন্দোলনের সময় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (নিসআ) নামের একটি সংগঠন গঠিত হয়। সেই সংগঠন দফায় দফায় নানা কর্মসূচি পালন করেছিল। নিরাপদ সড়কের দাবি এখনো কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না, জানতে চাইলে সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘এখনকার মতো ছোট ছোট কর্মসূচি পালন করে এমন বড় দাবি আদায় সম্ভব নয়। আমরা যখন ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিলাম, তখন আমাদের অনেকেই হামলা-মামলার শিকার হয়। নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন কর্মসূচির পরিকল্পনা দরকার। সে লক্ষ্যেই আমরা সংগঠিত হচ্ছি। ’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036880970001221