মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যেকার সংঘাত চলমান এবং রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছে। রাখাইনের মংডু শহরতলী এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী এএ’র সঙ্গে তীব্র সংঘাতে লিপ্ত। সংঘর্ষের কারণে বিপুল সংখ্যক এএ’র সদস্যদের পাশাপাশি জোরপূর্বক নিয়োগ করা রোহিঙ্গারাও হতাহত হচ্ছে। চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং তারা তাদের গ্রামগুলো থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।
রাখাইন রাজ্যের চলমান সংঘাত থেকে বাঁচতে নতুন করে ৪০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইউ কিয়াও সোয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখন প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এএ’র সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান সংঘাতের মধ্যে জুলাই ও আগস্ট মাসে কয়েক দফায় নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ১২৩ সদস্য প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ সরকার তাদেকে ২৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। এর আগে তিন দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বিজিপি ও মিয়ানামার সেনাবাহিনীর ৭৫২ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সেনাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি তাদের প্রত্যাবাসন সহজতর করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি তার সরকারের কৃতজ্ঞতার কথা জানায়।
মিয়ানমারে বসবাসকারী ৬ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা এবং নজরদারি টাওয়ার দ্বারা সুরক্ষিত ক্যাম্পে বসবাস করছে এবং বাকি রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচে বন্দি অবস্থায় টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করে বাস্তুচ্যুত অধিবাসীদের জন্য সহায়তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। এর ফলে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হবে। তিনি জানান যে, এটি রাখাইনের বিদ্যমান সংকট সমাধানে একটি ভালো সূচনা হতে পারে এবং বাংলাদেশে হাজার হাজার নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারবে। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্টার থমাস অ্যানড্রুজের সঙ্গে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় রোহিঙ্গাদেরকে তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চায়। রাখাইনে সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুত জনগণের বিষয়ে আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য পরামর্শ দেন।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডার নিয়ে সম্মেলন আহ্বান করে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানকে (জেআরপি) শক্তিশালী করে ত্রাণ সহায়তা বাড়ানোর জন্য আরো রাজনৈতিক চাপ দেয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যামূলক অপরাধ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির ব্যবস্থাকে গুরুত্বসহকারে সমর্থন করার প্রস্তাব করা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার ও রাশিয়াসহ ছয় দেশের সমন্বয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি নতুন কর্মপরিকল্পনা নেয়ার চেষ্টা করছে। এর আওতায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত কিংবা তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যায় কি না সে বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এজন্য আগামী ডিসেম্বরে চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বৈঠক করার পরিকল্পনা করছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আগামী জুলাইয়ের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরো ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অধিবেশনেও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সামাজিক অস্থিরতা ও মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান যে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়া অঞ্চল সমস্যায় পড়বে, তাই সবাইকে অবশ্যই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো ও হামলার অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছে এ এ প্রধান মেজর জেনারেল তুন মিয়াত নাঈং। তিনি জানান যে, এই অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বর্তমান জান্তা সরকার এই উত্তেজনাকে আরো উসকে দিচ্ছে এবং মুসলিম গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে এএ’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। এএ প্রধানের মতে, রাখাইন রাজ্যে জাতিগত ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বকে সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তবে, এএ রাখাইন রাজ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য কাজ করছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে এ এ’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও, তুন মিয়াত নাঈং জানায় যে, এএ কোনও ধরনের জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাত উসকে দেয়নি, বরং স্থানীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ওপর জোর দিয়েছে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমার জান্তা ও রাখাইন উভয়ের দ্বারাই নিগৃহীত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তারা কাউকে তাদের পাশে পাচ্ছে না। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এ এ’কে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ এ’কে রাখাইন – রোহিঙ্গা সম্পর্ক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। এএ সুসংগঠিত ও রাজনৈতিক ভাবে রাখাইন রাজ্য তাদের প্রভাব বলয়ে রয়েছে। রাখাইন জনগণের ওপর তাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সুবিদিত। চলমান প্রেক্ষাপটে এএ’কে রোহিঙ্গাদের জন্য একটা আস্থার জায়গা প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হয়।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। তারা সংগঠিত নয় এবং নিজেদের ভেতরে একতার অভাব রয়েছে। তাদেরকে রাখাইনে ফিরে যাওয়া ও সেখানে বসবাস করার বিষয়ে একমত হতে হবে। এখনও অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না এবং একটা দল প্রত্যাবাসন বিরোধী। মিয়ানমারে তাদেরকে ফিরে যেতে হবে এটা সব রোহিঙ্গাকে বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। গত সাত বছরে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে প্রত্যাবাসন বিষয়ে যারা সোচ্চার ছিলো তাদেরকে কোনো না কোনো ভাবে হয়রানি করা হয়েছে ও হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে যারা কথা বলে তাদেরকে টার্গেট করে হত্যা করাও হয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতিশীল ও টেকসই করতে মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী, বৌদ্ধ ভিক্ষু সংগঠন, রাখাইন প্রদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যবধান গুছিয়ে আন্তরিক পরিবেশ ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, অভিবাসী রোহিঙ্গা সংগঠন, এনইউজি ও এএ এবং রোহিঙ্গা অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোকে এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ইস্যুটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ। জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জুন রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের নাগরিকত্ব আইন বিলোপের অঙ্গীকার করে, এই আইন দ্বারাই রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়েছিলো। এটি এনইউজির তরফ থেকে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। যেখানে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়া হয়। এএ’ও রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনের নাগরিক হিসেবে মনে করে বলে জানায়। সামনের দিনগুলোতে তাদেরকেও এ বিষয়ে আরো আন্তরিক হতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মহল ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সকল পক্ষ, এনইউজি ও এএ, বিদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ ও সংগঠন সবাই মিলে সমন্বিত ভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ বজায় রাখতে হবে এবং এই সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে।
মিয়ানমারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘ, চীন, ভারত, আসিয়ান ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের একত্রে এগিয়ে আসতে হবে। চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই লাভের সম্ভাবনা নেই বরং এতে জনগণের ভোগান্তি ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে ও তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দ্রুত এই সংকটের সমাধান দরকার।
রাখাইনের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার, এএ, জাতিসংঘ ও সাহায্য সংস্থা এবং অন্যান্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অশান্ত রাখাইনে বহু দিন ধরে জনগণ দুর্দশায় রয়েছে। শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরে আসলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে তারা রাখাইনের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
দীর্ঘ সাত বছরে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সংকটের মোকাবিলায় একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে একটা কার্যকরী রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরি ভিত্তিতে আপদকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন আগত রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নেয়া শিশু সহ বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় চলমান মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কূটনীতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা কমিশন গঠন করে চলমান কূটনীতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি ট্র্যাক ১.৫ ও ট্র্যাক ২ কূটনীতির মাধ্যমে পরিস্থিতি উন্নয়ন ও সংকট সমাধানে নানামুখি কার্যক্রম নেয়া যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান সহজ হবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক