রাগান্বিত বিচারক, প্রতিবাদী ছাত্রী

মো. রহমত উল্লাহ্ |

সম্প্রতি বগুড়ার একজন বিচারক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তাতে বিষয়টি আবার ব্যাপক আলোচনায় চলে এসেছে যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সাধারণ মানুষকে দেশের মালিক তো দূরের কথা মানুষই মনে করেন না! সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে এসেছে সরকারিদের এই মনোভাব। তাইতো দেশ স্বাধীনের পরপর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, মানুষকে সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। তারাই দেশের মালিক। 

আশা ছিলো, পরিবর্তন হবে সরকারিদের ‘মালিক বনে যাওয়া’ মনোভাব। কিন্তু অর্ধশত বর্ষ চলে গেলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না খুব বেশি পরিবর্তন। তাইতো জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, `মানুষকে অবহেলার চোখে দেখবেন না বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন না। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেবেন। রিকশাওয়ালাকেও আপনি করে বলবেন। মনে রাখবেন, আমরা জনগণের শাসক নয়, সেবক।’ 

সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্যে আমরা আসলেই খুব সম্মানিত বোধ করি এবং সরকারিদের কাছ থেকে সদ্ব্যবহার প্রত্যাশা করি। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমনভাবে দেখি না, পাই না, ভোগ করি না। 

বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে তার মেয়ের সহপাঠীদের অভিভাবকদের হেনস্তা, অবৈধভাবে ক্ষমতা ব্যবহার, সাইবার আইনে শিক্ষার্থীদের মামলার হুমকি ও অভিভাবকদের পা ধরতে বাধ্য করার প্রতিবাদে গত ২১ মার্চ রাস্তায় নেমে আসে বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন অভিভাবকরা। ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে। এক পর্যায়ে গত ২৩ মার্চ রুবাইয়া ইয়াসমিনকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

জানা যায়, বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা পালা করে নিজেদের ক্লাসরুম নিজেরাই পরিষ্কার করে থাকে। কিন্তু কিছুদিন আগে ভর্তি হওয়া ওই বিচারকের মেয়ে স্কুলের এই নিয়ম মানতে চান না। সহপাঠীদের সঙ্গে ক্লাসরুম পরিষ্কার করতে অনীহা দেখায় এবং নিজেকে উত্তম ও অন্যদের অধম ভাব প্রকাশ করেন। এটি নিয়ে গত ২০ মার্চ তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠে! বিচারকের মেয়ে বাসায় গিয়ে অন্য শিক্ষার্থীদের ‘বস্তির মেয়ে’ উল্লেখ করে ফেসবুকে কটুক্তি করে স্ট্যাটাস দেয়। সেই স্ট্যাটাসে তার সহপাঠীরাও কটূক্তিমূলক মন্তব্য করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ নিয়ে গত ২১ মার্চ সকাল ১১ টার দিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনের কক্ষে উপস্থিত হন ওই বিচারক। প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে অপমান-অপদস্ত করে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে তার পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। 

এসব ইস্যুতে ওই দিনই প্রতিবাদী হয়ে উঠে বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ভিডিও এ ঘটনায় সর্বাধিক প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে ওই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মরিয়ম আক্তার মাহিকে। 

ভিডিওটিতে দেখা গেছে, ডিসি সাহেবসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে লাইভে এসে যেভাবে মাহি বক্তব্য দিয়েছে তাতে তার মধ্যে নেতৃত্বের অনেক গুণাবলী লক্ষণীয়। সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নেতা হয়ে তাদের মনের কথা সে উপস্থাপন করেছে। সবার বিবেক জাগ্রত করার মতো ছিলো মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই প্রতিবাদী শিক্ষার্থীর ভাষা। অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত প্রতিবাদ ছিলো তার বক্তব্যের সারাংশে। এক পর্যায়ে সে ডিসি সাহেবকে বলেছে, আপনি এখন অবশ্যই বিশেষ। কেননা, আপনি এখন ডিসি সাহেব ও সভাপতি সাহেব হিসেবে এখানে এসেছেন। কিন্তু যখন আপনি আপনার মেয়ের অভিভাবক হিসেবে এখানে আসবেন তখন আপনিও অন্যান্য অভিভাবকের সমান। অথচ জজ সাহেব নিজের মেয়ের অভিভাবক হিসেবে স্কুলে এসে বড় ম্যাডামের রুমে বসে আমাদের ও আমাদের অভিভাবকদের ডেকে এনে অনেক অপমান করেছেন। আমাকে তুই তুকারি করেছেন। বলেছেন, তুই বেশি বেশি করছিস। তোর বাবা তরমুজের না কিসের ব্যবসায়ী। তুই আমার পাওয়ার জানিস? তোর কী ক্ষমতা আছে এরকম করার? জানিস, তোদের নামে মামলা দেবো! জানিস, শিশু কারাগার আছে? তুই আমার ক্ষমতা দেখতে চাস? আমি ইংল্যান্ড আমেরিকা থেকে পড়াশোনা করে আসছি। তুই জানিস আমার কতগুলা ডিগ্রি আছে? তখন বড় ম্যামও জজ সাহেবের সাপোর্টে ছিলেন। বলছিলেন, আমাকে টিসি দেয়া হবে, জেলে দেয়া হবে। এসব করে আমার মাকে একরকম ফোর্স করা হইছে পা ধরার জন্য। পরে মা পা ধরে ক্ষমা চাইছে, আমিও ক্ষমা চাইছি। পরে ক্লাসরুমে গিয়ে বড় ম্যাম বলেছেন, যা হইছে ভালোই হইছে। পা ধরলে কারো জাত যায় না। এখানে আমার কোশ্চেনটা হচ্ছে, পা ধরলে যখন কারো জাত যায় না তখন জজ সাহেব এসে আমার মায়ের পা ধরলে তার তো জাত যাবে না। যদিও আমার মা এরকম না যে তাকে পায়ে ধরতে দেবে। বড় ম্যাম মাঠে এসে বলেছেন, তোমরা তিনজন কিন্তু বিপদে পড়বা। আমরা বড় ম্যামের বদলি চাই। আর ওই মেয়েটা (জজ সাহেবের মেয়ে) যদি এখানে থাকে আমরা পড়বো না এখানে। 

লক্ষণীয় যে, জজ সাহেবের এমন ভাষা ও মানসিকতা ওনার মেয়ের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এখানে অন্য যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় তা হচ্ছে, মাহির সেই প্রতিবাদের ভাষা অত্যন্ত জোরালো, ধারালো ও যৌক্তিক। তার উপস্থাপনা সাবলীল, ভাষা সংযত, মনোবল অধিক, সৎ সাহস অত্যাধিক। তার মধ্যে একিভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত। সেই সঙ্গে সাধারণের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার বিদ্যমান। তার সঠিক নেতৃত্বের ফলেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নীতি, নৈতিকতা, ন্যায্যতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ ও সম্মানবোধের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছেন উচ্চশিক্ষার সনদধারী একজন বিচারক। আমার মনে হচ্ছে, প্রয়োজনীয় উৎসাহ, উদ্দীপনা, দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা পেলে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে সে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, এই আন্দোলন থেমে গেলে, সবার দৃষ্টি সরে গেলে, মাহি একা হয়ে গেলে, তদন্ত ঘুরিয়ে দেয়া হলে, এই প্রতিবাদের প্রতিশোধ নেয়া হলে- বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তার ও তার অভিভাবকের! সেই সাথে ফেঁসে যেতে পারে তার সহপাঠীরাও! বড় ম্যাম তো বলেই দিয়েছেন, তোমরা তিনজন কিন্তু বিপদে পড়বা! এ বিষয়ে এলাকার ছাত্রশিক্ষকসহ সক বিবেকবান মানুষ সজাগ দৃষ্টি রাখবেন আশা করি এবং সেই সাথে এও আশা করি যে, ভয়-ভীতি, রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে ওঠে বড় মনের পরিচয় দিবেন বড় ম্যাম তথা প্রধান শিক্ষক। 

মরিয়ম আক্তার মাহিসহ সব প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বলবো, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সুশৃঙ্খল হয়ে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যেতে হবে সামনে। আমাদের সমাজে খুব বেশি প্রয়োজন তোমাদের মতো প্রতিবাদী মানুষের। আবেগে, উচ্ছ্বাসে, যৌবনে, পরিবেশে, প্রতিকূলতায় ছিটকে গেলে চলবে না তোমাদের। ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহারে আসক্ত হয়ে বখে গেলে চলবে না তোমাদের। শুধু ডিগ্রি নিয়ে নয়, সুশিক্ষা নিয়ে এ প্লাস মানুষ হয়ে আরো বড় বড় ক্ষেত্রে গিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে করতে হবে অন্যায়ের প্রতিরোধ।

লেখক :  মো. রহমত উল্লাহ্, শিক্ষাবিদ ও অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041229724884033