‘অনার্স শেষ করতে আর কত বছর লাগবে প্রায় আব্বা-আম্মা জিজ্ঞেস করেন। ক্লাস শুরু করেছি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এসেও শেষ করতে পারিনি দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা। পরীক্ষা কবে হবে নির্দিষ্টভাবে কিছুই জানি না।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলছিলেন তার সেশন জটের কথা।
শুধু এই বিভাগই নয়; কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পাঁচ বিভাগে তিন বছরেও শেষ হয়নি তিন সেমিস্টার। ২০১৯-২০ সেশনের ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে ক্লাস শুরু হয় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে এসেও রয়েছে এই অবস্থা। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলছেন, শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসগুলো না নেওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বিভাগগুলো বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল; সেটাই পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। আর শিক্ষা গবেষকদের মতে, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতা ও ইয়ার সিস্টেম থেকে সেমিস্টার চালু করায় অনেক শিক্ষক এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। এমনকি কিছু শিক্ষকের কোর্সের রেজাল্ট আটকিয়ে রাখার ফলেও শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে আইন অনুষদ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক অনুষদে সেমিস্টার সিস্টেম চালু করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সেশনের ইংরেজি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (আইআর), উর্দু, নাট্যকলা, মিউজিক ও ফোকলোর বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টার শেষ হয়নি। অন্যদিকে ফাইন্যান্স, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষা শীতকালীন ছুটির আগে শেষ হয়েছে, কিন্তু ক্লাস শুরু হয়নি। এই বিভাগগুলোর মধ্যে সবই তৃতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা শুরুর তারিখ দিলেও ফোকলোর ও উর্দু বিভাগ এখনো দেয়নি।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে ফোকলোর বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সেমিস্টারগুলো কি সঠিক নিয়মেই চলছে, করোনা মহামারীতে ঘরবন্দি কেটে যাওয়া ১৮ মাসই যথেষ্ট।’
একই সেশনের আরেক শিক্ষার্থী অীভযোগ করে বলেন, ‘বর্তমানে ঢাবি-চবির বিভিন্ন বিভাগ কিংবা রাবির অন্যান্য বিভাগে আমার বন্ধুরা তৃতীয় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারে পড়ছে, আবার কেউ কেউ দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা দেবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের রুটিনে ক্লাস সংখ্যা খুবই স্বল্প। তারপরও শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেয় না। শিক্ষকদের বারবার বলেও পরীক্ষা এগিয়ে নিয়ে আসতে পারিনি।’
উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ফলাফলের অসঙ্গতি নিয়ে অনেক আন্দোলন করেছি। অনশনেও বসেছি। সেটার সমাধান প্রক্রিয়া এখনো চলমান। তৃতীয় সেমিস্টারের ক্লাস শেষ হলেও পরীক্ষার তারিখ এখনো দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারার প্রথম কারণ, কভিডের দেড় বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকা। আর দ্বিতীয়ত, আমার বিভাগে মাত্র পাঁচজন শিক্ষক। এই স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে ৩৭টি কোর্স তো কখনো কাভার করা যায় না।’
উর্দু বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, ‘২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনের কারণেই মূলত সবকিছু স্তিমিত হয়ে আছে। যে কারণে ওই সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের এখনো তৃতীয় সেমিস্টারে ভর্তি করাতে পারিনি। ক্লাস সম্পূর্ণ করা হয়েছে। শুধু পরীক্ষাটা বাকি আছে। আশা করছি শিক্ষার্থীদের রেজাল্টের বিষয়টি সুরাহা করেই খুব শীঘ্রই তৃতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষাটা নিয়ে নেব।’
ইংরেজি বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক রুবাইদা আখতার বলেন, ‘লকডাউনের কারণেই তাদের ‘গ্যাপ’ হয়েছে। এটাই মূল কারণ। তা ছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই তাদের পিছিয়ে থাকার।’
শিক্ষার্থীদের সেশন জটে আটকে পড়ার কারণ হিসেবে চারটি বিষয় থাকতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক আকতার বানু। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার প্রথম কারণ অবশ্যই দেড় বছরের লকডাউন। দ্বিতীয়ত, ইয়ার সিস্টেম থেকে সেমিস্টার চালু করায় অনেক শিক্ষক এখনো ‘ইউজ টু’ হতে পারেনি। তৃতীয়ত, লকডাউনে হয়তো অনলাইনে ক্লাস তারা নিতে পারেনি। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব ছিল। চতুর্থত, অনেক বিভাগে শিক্ষক স্বল্পতা আছে। যে কারণে কোর্সগুলো সময়মতো শেষ করতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেক বিভাগকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে যাতে খুব শীঘ্রই কোর্স শেষ করে পরীক্ষা নেয়।