রামমোহন ও বিদ্যাসাগর

চৌধুরী মুফাদ আহমদ |

দেশে এখন জাঁকজমকপূর্ণ শান্তির সময়। এখন চিতাবাঘের পাশে হরিণ, হাঙ্গরের পাশে মাছ, বাজের নিকটে কপোত এবং ঈগলের পাশে চড়ুই শুয়ে থাকে’ – এভাবেই ফকির খাইরুদ্দিন এলাহাবাদি উনিশ শতকের প্রথম দশকের ভারতকে বর্ণনা করেছেন। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দের দিল্লির এবং মহারাষ্ট্রের অসইয়ের লড়াইয়ে মারাঠা শক্তির বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয়ের মাধ্যমে কার্যত ভারতের স্থানীয় শক্তির বিরুদ্ধে ইংরেজদের জয় সম্পূর্ণ হয়। এর আগে মীর কাশিম, সুজাউদ্দৌলা, টিপু সুলতান প্রমুখের প্রতিরোধ ছলে-বলে-কৌশলে ইংরেজরা নস্যাৎ করেছে। দিল্লির লড়াইয়ের পর অন্ধ মোগল সম্রাট শাহ আলম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুরক্ষায় নামমাত্র সম্রাটে পরিণত হন এবং ভারতে দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ শাসনের পাকাপোক্ত ভিত নির্মিত হয়। এসময়ই অভিজাত মুসলমানরা মনে করেন, দ্বাদশ শতাব্দীর পর এই প্রথম ভারতের শাসন মুসলমানদের হাত থেকে চলে গেল। দিল্লি জামে মসজিদের ইমাম শাহ্ আব্দুল আজিজ লিখেছিলেন, এখান (দিল্লি) থেকে কলকাতা পর্যন্ত এখন খ্রিস্টানদের নিয়ন্ত্রণে … এই দেশ আর ‘দারুল ইসলাম’ নয়।’ ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী কয়েক দশক ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনের অধীনে একটি সুস্থির সময়। কলকাতা তখন ইংরেজদের রাজধানী। কলকাতার হিন্দু ‘ভদ্রলোক’দের কাছে এই সময়টা ছিল এক স্বস্তির সময়। ইংরেজ শাসনের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতা প্রচুর। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, মহাজনি ব্যবসা করে প্রচুর বিত্ত-বৈভবের মালিক হচ্ছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর কারণে পুরোনো জমিদারদের সম্পত্তি নিলাম হলে সেই জমিদারি কিনছেন, আবার সেগুলি অন্যদের কাছে পত্তন দিচ্ছেন। কলকাতাকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে একটি হিন্দু মধ্যশ্রেণি গড়ে উঠছে। তাদের মধ্যে ইংরেজি শেখার আকাঙ্ক্ষা তীব্র। এরকম একটি সময়ে কলকাতা কেন্দ্রিক বঙ্গীয় জাগরণের সূচনা এবং রামমোহন রায়ের আবির্ভাব।

উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ প্রসঙ্গে আলোচনায় রামমোহন রায়ের পর যে-নামটি উচ্চারিত হয় তিনি বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়ের চেয়ে বয়সে ৪৮ বছরের  ছোট ছিলেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডে রামমোহন মারা যাওয়ার সময় বিদ্যাসাগর ১৩ বছরের বালক এবং সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। রামমোহনকে বিদ্যাসাগর দেখেননি। কিন্তু সংস্কৃত কলেজের ছাত্র হিসেবে বালক বয়সেই তাঁর সম্পর্কে নিশ্চয়ই জেনেছিলেন এবং যা জেনেছিলেন তা নেতিবাচক হওয়ারই কথা। কারণ. রামমোহন রায়ের বিরোধী রক্ষণশীলদের একটি দুর্গ ছিল সংস্কৃত কলেজ। বিদ্যাসাগরের শিক্ষকরা ছিলেন রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’র বিরোধী ‘ধর্মসভা’র সঙ্গে সম্পর্কিত। রামমোহন-ডিরোজিও-ইয়াং বেঙ্গলরা সমাজে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্যেই বিদ্যাসাগর বেড়ে ওঠেন। বিদ্যাসাগরের বালক বয়সে বারাসতে ওহাবী আন্দোলনের মোড়কে তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তাঁর বয়স যখন ৩৭ বছর-তখন ইংরেজ সরকারবিরোধী মহাবিদ্রোহ ঘটে। এর পরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনব্যবস্থা ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয় এবং ভারতবাসী ‘মহারাণী’ ভিক্টোরিয়ার প্রজায় পরিণত হয়। পরবর্তীতে বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নানারূপ পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং বাঙালি মধ্যবিত্তের পূর্ববর্তী স্বস্তির অবস্থাও নানা কারণে পরিবর্তিত হতে থকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভেতর থেকেই তখন ধীরে ধীরে একটি বাঙালি মুসলমান মধ্যশ্রেণির জন্ম হচ্ছে। তারাও তখন ইংরেজি শেখা শুরু করেছে। এসময় ইংরেজ শাসনের প্রতি মুগ্ধতা কমে জাতীয়তাবাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। তাই রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের বিদ্যমান থাকার সময় কাছাকাছি হলেও দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্যও ছিল।

রামমোহন ও বিদ্যাসাগর দুজনই তাঁদের সমাজের সময়ের ব্যতিক্রমী ও অগ্রসর ব্যক্তি। দুজনই রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে নিরলস লড়েছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো হননি। দুজনেরই নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। তৎকালীন হিন্দু সমাজের সংস্কারে, বাংলা ভাষা নির্মাণে, শিক্ষার প্রসারে, নারীর অধিকারের পক্ষাবলম্বনে সর্বোপরি আধুনিক চিন্তার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের উজ্জ্বল পূর্বসূরি রামমোহন। আবার তাঁদের মধ্যে পার্থক্যও ছিল । পার্থক্য ছিল জীবনচর্যায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। কখনো তাঁরা একই পথের পথিক, কখনো বা বিপরীত চরিত্রের মানুষ।

রামমোহনের মূল মিশন ছিল, ধর্মসংস্কার এবং তিনি তাঁর এই কাজে একা ছিলেন। সহমরণ নিবারণসহ অন্যান্য কাজে তিনি যাঁদের কাছে পেয়েছিলেন তাঁরাও তাঁর ধর্মমতের সমর্থক ছিলেন না। পৌত্তলিকতার বিরোধিতার জন্য তিনি পারিবারিকভাবে নিগৃহীত এবং রক্ষণশীলদের তীব্র বিরাগভাজন হয়েছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু করে প্রচুর শত্রু সৃষ্টি করেছিলেন, আবার অনেককেই তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন। সতীদাহ নিবারণ আন্দোলনে যাঁরা রামমোহনের সঙ্গে ছিলেন তাঁদেরও কেউ কেউ বিধবাবিবাহ সমর্থন করে বিদ্যাসাগরের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আবার রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তাঁদের দুজনের বিরোধীপক্ষও প্রায় অভিন্ন ছিল।

রাজা রামমোহন রায় কোনো রাজা ছিলেন না, তাঁর পারিবারিক পদবিও ‘রায়’ ছিল না। ‘রাজা’ ও ‘রায়’ দুটোই তাঁর উপাধি। তাঁকে রাজা উপাধি দেন ইংরেজের পেনশনভোগী নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পেনশন ও সুবিধা পাওয়ার কথা তার চেয়ে কম পাওয়ায় সম্রাট অসন্তুষ্ট ছিলেন। রামমোহন রায় ইংল্যান্ড যাওয়ার খবর পেয়ে তিনি ইংল্যান্ডের রাজদরবারে তাঁর হয়ে কথা বলার জন্য তাঁর দূত হিসেবে রামমোহনকে মনোনীত করেন এবং ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেন। তিনি ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে মাত্র চার বছর বেঁচে ছিলেন। এর আগে তাঁকে ‘দেওয়ান’ রামমোহন রায় বলা হতো- কারণ তিনি ইংরেজ কালেক্টরের দেওয়ান ছিলেন। রামমোহনের প্রপিতামহ মোগল সরকারের কাজ করে ‘রায়’ উপাধি পান। রামমোহন ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং তাঁদের প্রকৃত পারিবারিক পদবি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’; কিন্তু তাঁদের সেই উপাধি পুরুষানুক্রমে ঢাকা পড়েছিল মোগলের দেওয়া ‘রায়’ উপাধির নিচে। রামমোহনের পিতামহ ব্রজবিনোদ রায় এবং পিতা রামকান্ত রায় মুর্শিদাবাদে নবাব-সরকারে কাজ করেছেন।

রামমোহনের মতো ঈশ্বরচন্দ্রের পারিবারিক পদবিও ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা পুরুষানুক্রমে ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তাই তাঁদের বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিও ঢাকা পড়েছিল উপাধির নিচে। এই উপাধি ছিল সংস্কৃত পণ্ডিতের উপাধি। ঈশ্বরচন্দ্রের প্রপিতামহ ছিলেন ভুবেনশ্বর বিদ্যালঙ্কার, পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ আর ঈশ্বরচন্দ্র তো ‘বিদ্যাসাগর’ হিসেবেই ভুবনবিখ্যাত হন। বিদ্যাসাগরের ভাইদের, পুত্রেরও নামের শেষে এরূপ উপাধি ছিল, তাঁরাও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। দারিদ্র্যের কারণে তিনি কুলপ্রথা গ্রহণ করার মতো সংস্কৃত শিখতে পারেননি। তাই তাঁর কোনো উপাধি ছিল না। (চলবে)

লেখক : প্রাবন্ধিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026299953460693