বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে পুলিশের এসকর্ট সুবিধা গত ১৪ মে প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার। পুলিশের পরিবর্তে তাদের নিরাপত্তায় প্রস্তুত করা হয়েছে আনসারের বিশেষ প্রশিক্ষিত জনবল। তবে এসব আনসার সদস্যদের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিতে গেলে অর্থ খরচ করতে হবে কূটনীতিকদের। সেক্ষেত্রে জনপ্রতি আনসার সদস্যকে ৩০০ ডলার করে দিতে হবে।
আগে পুলিশি নিরাপত্তার জন্য কোনও অর্থ খরচ করতে হতো না বিদেশি কূটনীতিকদের। মূলত সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিনামূল্যে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হতো। তবে গত ১৪ মে বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় সরকার পুলিশের এসকর্ট সুবিধা তুলে নেওয়ায় এখন থেকে অর্থ খরচ করে নিরাপত্তা নিতে হবে তাদের।
বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছ থেকে গাড়ি নিলে জ্বালানি খরচ ছাড়াও সঙ্গে দিতে হবে আরও এক হাজার ডলার। এছাড়াও অন্য কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট লাগলে তাও বহন করতে হবে ওই দূতাবাসকেই।
গত ১৭ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, কূটনীতিকদের আনসার বাহিনী কীভাবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়েছে। নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আনসার বাহিনীর সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দূতাবাসগুলোতে কূটনৈতিক পত্র পৌঁছে গেছে। পত্রে এসকর্ট সুবিধা পেতে হলে যোগাযোগের জন্য পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ডিরেক্টরের (অপস) ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি কোনো বিদেশি কূটনীতিক।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দূতাবাসে ছয় বছর নিরাপত্তায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের (এজিবি)। পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত লোকবল সরবরাহের সক্ষমতাও রয়েছে বাহিনীটির।
১৭ মে বৈঠক শেষে আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক বলেন, কূটনীতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত আছে আনসার বাহিনী।
তবে এখন পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থিত কোনো বিদেশি দূতাবাস থেকে কূটনীতিক নিরাপত্তার জন্য আনসারের এসকর্ট সুবিধা পেতে আনুষ্ঠানিক আগ্রহ দেখানো হয়নি, এমনকি জানানো হয়নি লিখিত চাহিদাও।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আনসার সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন-এজিবি ইউনিট গঠন করা হয়। গঠন করা হবে আরও একটি ব্যাটালিয়ন, সে প্রক্রিয়া চলছে।
আনসার সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একজন পরিচালকের নেতৃত্বে আটজন কর্মকর্তা ও ৪১৬ জন আনসার সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত এজিবি। এজিবির মতো প্রশিক্ষিত জনবলে রয়েছেন আরও তিন হাজার সদস্য। কূটনীতিকদের নিরাপত্তায় এজিবিকে ব্যবহার কিংবা প্রশিক্ষিত আনসার সদস্যদের নিয়ে আলাদা ব্যাটালিয়নও গড়া যেতে পারে। এতে পোশাকসহ কাঠামোগত পরিবর্তনও প্রয়োজন হবে না।
আনসার সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের (এজিবি) সদস্যদের দেশে-বিদেশে কুইক রেসপন্স ট্রেনিং (কিউআরটি), স্পেশাল ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং (এসটিটি), স্পেশাল প্রটেকশন ট্রেনিং ও বিশেষ অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও রয়েছে। আনসারের কর্মকর্তারা এসএসএফ ও র্যাব, সচিবালয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে প্রেষণে কর্মরত থেকে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
বুধবার (২৪ মে) সকালে আনসার ও গ্রামপ্রতিরক্ষা বাহিনীর পরিচালক (অপারেশনস) সৈয়দ ইফতেহার আলী বলেন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আমাদের পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
এসকর্টের জন্য বুধবার (২৪ মে) সকাল পর্যন্ত আনসার সদস্যদের ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে কোনো দূতাবাস যোগাযোগ করেছে কি না জানতে চাইলে সৈয়দ ইফতেহার বলেন, এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ আছে। তবে দূতাবাসগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই যোগাযোগ করে থাকে। কোনো দূতাবাস আগ্রহ দেখালে বা চাহিদা দিলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে চিঠির চাহিদা আসবে আনসার অধিদপ্তরে। তখন আমরা ডিপ্লয়মেন্ট করব। আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি আছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা সড়কে ট্র্যাফিক ক্লিয়ারেন্সের জন্য পুলিশের বাড়তি প্রটোকল পেতেন। পরে আরও কিছু দেশ এই সুবিধা চাওয়া শুরু করে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় এই প্রটোকলের আর প্রয়োজন হবে না উল্লেখ করে গত ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ ৬টি দেশের রাষ্ট্রদূতের রাস্তায় চলাচলে এসকর্ট সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। পরে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, কোনো দূতাবাস চাইলে নিরাপত্তার জন্য অর্থের বিনিময়ে আনসারের প্রশিক্ষিত সদস্যদের নিতে পারবে।
বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহারের কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গত ১৭ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যখন জঙ্গিদের উত্থান হয়েছিল, অগ্নি-সন্ত্রাসের একটা রাজত্ব হয়েছিল, তখন চারটি দূতাবাসকে আমরা সড়কে নিরাপত্তা দিতাম। এটি কিন্তু লিখিতভাবে দেওয়া হয়নি। তারাও আমাদের অনুরোধ করেনি। আমরাই তাদের দিয়েছিলাম, যাতে করে তারা কোনোরকম অসুবিধায় না পড়ে। আমরা মনে করি, সেই পরিস্থিতি এখন নেই।
তিনি বলেন, এরপরও যদি কোনো রাষ্ট্রদূত মনে করেন প্রয়োজন, তবে নতুন করে আনসার গার্ড রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়েছে, তারাই সেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। এজন্য অর্থ দিতে হবে। আর এই ব্যয় দূতাবাসকে বহন করতে হবে।
পুলিশের এসকর্ট প্রত্যাহারের পরদিন ১৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান উপ-মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের স্থাপনা ও এর কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা স্বাগতিক (হোস্ট) দেশের দায়িত্ব এবং তা অবশ্যই পালন করতে হবে।