ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতে ‘ফিউশন’ বিষয়টি সর্বপ্রথম যোগ করেছিলেন রাহুল দেব বর্মণ অর্থাৎ আর ডি বর্মণ। তিনি গানে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সংগীতের অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সেই রাহুল দেব বর্মণের প্রয়াণ দিবস আজ।
তার হাত ধরেই ভারতীয় সংগীতে এসেছিলো ইলেকট্রিক গিটার, রক অ্যান্ড রোলের সংমিশ্রণ। বলিউডে তিনিই প্রথম লোকজ ধারার সঙ্গে জ্যাজ, ব্লুজ ও ডিস্কো ধারার প্রবর্তন করেন।
রাহুল দেব বর্মণ উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক। তিনি কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণের গর্বিত সন্তান। তার আরেক নাম পঞ্চম। আর ডি বর্মণের জন্ম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুন কলকাতার ত্রিপুরায়। বাবা শচীন দেব বর্মণ কখনো চাননি ছেলে সংগীত শিল্পী হোক। কিন্তু রক্তে ধারণ করা সংগীতের প্রতি অনুরাগ রাহুলকে নিয়ে যায় সুরের ভুবনে। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা রাহুল দেব বর্মণ। প্রচুর হিন্দি গান করলেও তিনি ছিলেন আগাগোড়া বাঙালি।
তিনি গায়ক কিশোর কুমার এবং গায়িকা লতা মঙ্গেশকর এবং আশা ভোঁসলেকে দিয়ে অনেক জনপ্রিয় গান বানিয়েছিলেন। তিনি এখনও পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমার সংগীত জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক রূপে বিবেচিত হন। রাহুল তার পরে আসা সংগীত পরিচালকদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে রাহুলের প্রথম স্ত্রী ছিলেন রিটা। রিটা প্যাটেল নাম্নী এই তরুণীর সঙ্গে রাহুলের দার্জিলিংএ পরিচয় হয়েছিলো। রিটা তার বান্ধবীদেরকে বাজী লাগিয়েছিলেন যে তিনি রাহুলের সঙ্গে ডেটিং এ যাবেন, হয়েওছিলো তাই, রাহুল রিটাকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে করেন। মাত্র ৫ বছর স্থায়ী হয়েছিলো সেই দাম্পত্য জীবর। রাহুলের সঙ্গে রিটার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং রাহুল শোকে মুষড়ে পড়েছিলেন। রাহুল 'মুসাফির হুঁ ইয়ারো' গানটির সুর রিটার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরেই করেন, কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়ানো গানটি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিলো, গানটি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের চলচ্চিত্র ‘পরিচয়’ এর জন্য ছিলো। এরপর দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে গায়িকা আশা ভোঁসলেকে বিয়ে করেন রাহুলদেব। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে গণপত রাওয়ার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আশা নিজের কেরিয়ারে মনোনিবেশ করতে থাকেন। দুজনের পরিচয় দীর্ঘদিনের। গানের মধ্যে দিয়েই তৈরি হয়ে যায় পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।
আর ডি বর্মনের প্রেমের প্রস্তাবে আশা ভোঁসলে প্রথমে সেভাবে না এগোলেও, পরের দিকে প্রেমে পড়ে বিয়েও করেন দুজনে। পরবর্তীকালে তাদের বিয়ে হলেও সাংসারিক জীবন খুব একটা সুখের হয়নি বলে জানা যায়। স্বামীর প্রতি অনুযোগ ছিল আশার। পঞ্চম সব ভালো ভালো প্রেমের গান দিয়ে দেন দিদি লতাকে, আর আশার জন্য থাকতো ক্যাবারে, জ্যাজ প্রধান সব গান। এই নিয়ে বাকবিতণ্ডাও কম হয়নি দুজনের। পরবর্তীকালে আশা নিজেই জানিয়েছেন একাধিক সাক্ষাত্কারে| তবে আশা ভোসলে-রাহুল দেববর্মণ জুটি আমাদের উপহার দিয়েছেন কালজয়ী সব গান। আশা রাহুলের চেয়ে ছয় বছরের বড় ছিলেন। তিনি আজীবন রাহুলকে মূলত বন্ধু মানতেন।
আর ডি বর্মন বৈষয়িক দিকে সম্পূর্ণ উদাসীন। তিনি ছিলেন দিলদার। নিজের মিউজিশিয়নদের অসম্ভব ভালো বাসতেন আর সন্মান করতেন। তার সুরে গান কিশোর কুমার থেকে অমিত কুমার, মান্না দে, মহম্মদ রফি, ভুপিন্দর সিং, শৈলেন্দ্র সিং প্রমুখ। কিশোর কুমার এর গলায় সব থেকে বেশি গান রয়েছে তার সুর করা। কিশোর কুমারকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন আর ডি। আর ডি বর্মন এমন একটি নাম, যাকে নিয়ে লিখতে বসলে পাতার পর পাতা লিখলেও শেষ করা যায় না।
তার অনেক বাংলা গানের এ্যালবামও রয়েছে যেগুলো তিনি পুজার সময় বের করতেন এবং গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার গীতিকার হিসেবে থাকতেন।
৩৩ বছরের পেশাদারি জীবনে ৩৩১টি ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম ২৯২টি হিন্দি, ৩১টি বাংলা, ৩টি তেলেগু, ২টি তামিল, ২টি ওড়িয়া এবং ১টি মারাঠি ছবি। রাহুল জীবনে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ‘সানাম তেরি’ কাসাম সিনেমার সংগীত পরিচালনার জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পান।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে মুম্বাইতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক।