রিকশাচালক থেকে যেভাবে প্রভাষক হলেন মমিনুর

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি |

দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতার কাছে হার মানেননি দিনমজুর বাবার সন্তান মমিনুর রহমান মমিন (৩০)। পড়াশোনার খরচ যোগাতে করেছেন দিনমজুরের কাজ, চালিয়েছেন রিকশা। অবশেষে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় এনটিআরসির মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন অদম্য এই মেধাবী যুবক। 

সংগ্রামী মমিনুর রহমান কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মধ্যেকুমরপুরের সফপাড়া গ্রামের মো. নুর ইসলামের ছেলে। তার মায়ের নাম ময়না বেগম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মমিনুর সবার বড়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জেলার মধ্যকুমরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি ও ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পাস করেন মমিনুর। পরে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মমিনুর রহমান এক সময় খেত-খামারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে ও রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের স্নাতকে। সেখানে ইংরেজি বিষয়ে পড়া অবস্থায় প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বার বার ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন তিনি।

দারিদ্র্যের কারণে দফায় দফায় পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও দৃঢ় মনোবল থাকায় পরিশ্রম করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে মমিনুর পেয়েছেন সফলতা। তিনি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের আলিয়া মাদরাসার প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রিকশাচালক থেকে তিনি এখন ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক। ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় সারাদেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি। এ বছর ১০ মার্চ কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন। মমিনুরের সফলতার গল্প সাধারণ আর চার পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা, তাই তার সাফল্যে খুশি স্থানীয়রাও।

অদম্য মেধাবী মমিনুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যকর্মীর। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি যখন এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই, তখন প্রাইভেট পড়ার জন্য স্যারের বাড়িতে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ নিয়ে আমি মায়ের কাছে কান্নাকাটি করি। তখন নানার বাড়ি থেকে একটা পুরাতন সাইকেল পাই। তা দিয়ে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। কিন্তু স্যারদের বেতন দিতে পারি নাই। অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হই কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে। আমার মনে আছে, অন্যের জামা কাপড় পরে কলেজ করতাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনার্সে পড়ার সময় কতবার যে ঢাকার কেরানীগঞ্জে গিয়েছি রিকশা চালাতে, তার কোনো হিসাব নেই। কুমিল্লাতেও গেছি কাজের সন্ধানে। সে সময় যারা আমাকে কাজের জন্য কুমিল্লা নিয়ে গেছে, বাসে সিট পর্যন্ত দেয়নি, দাঁড়াই গেছিলাম। এসব কষ্টের কথা কি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারব বলেন? সত্যিকার অর্থে, আমার মত হাজারও মমিন বাংলাদেশে আছে, তারা অনেক সময় ভেঙে পড়ে। আমি মনে করি, ছেলেদের পক্ষে ভেঙে পড়ার সুযোগ নেই। ছেলেরা রিকশা চালাবে, ভ্যান চালাবে, কৃষি কাজ করবে, শ্রমিকের কাজ করবে। বাবা, মা ও পরিবারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। 

মেধাবী মমিন বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে ডিগ্রি পড়াবে, আমি শুনিনি বলে আমাকে কাজ করতে বলেন। আমি বলতে চাই, আমার মতো মমিন, যারা গরিব পরিবারের সন্তান, জীবনে কখনো হতাশ হওয়া যাবে না। জীবনে চলার জন্য অনেক পথ আছে। যদি ইচ্ছা থাকে, যেকোনো ভাবে বাস্তাবায়ন করা সম্ভব। যেটা আমি আমার জায়গা থেকে বুঝতে পারছি। সেদিন যদি আমি কেরানীগঞ্জ না যেতাম, তাহলে হয়তো আজকে আমি প্রভাষক মমিন হতে পারতাম না। তবে আমার স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়া।’

প্রভাষক মমিন আরও বলেন, ‘আমি ভাবি, যদি প্রভাষক হতে পারি, বিসিএস ক্যাডারও হতে পারব। জানি না কী হবে। যতটুকু সময় আছে, আমার জায়গা থেকে চেষ্টা করব। এখন তো আর আমার পিছু টান নেই। এখন আমার টেনশন নেই। আমার যে সময় পড়াশোনা করার সময় ছিল, তখন দুঃখ কষ্টে ভরা ছিল জীবন। ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারলে হয়তো অনেক আগেই ভালোকিছু হতাম।’

মমিনের বাবা নুর ইসলাম বলেন, ‘দিনমজুরের কাজ করে কোনরকমে সংসার চালাতাম। ছেলের এইচএসসি পাসের পর থেকে আর একটি টাকাও খরচ দিতে পারিনি। ছেলে নিজে দিনমজুরের কাজ ও ঢাকায় রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। তার ফল আজ সে পাইছে। আমি অনেক খুশি। আল্লাহ রহমত করছে। টাকার অভাবে ছেলে নিজে কাজ করে পড়াশোনা করেছে। এখন তার আয় দিয়ে আমার পরিবার চলছে। এর মধ্যে তার চাকরির খবরে আমি, তার মা ও তার দাদি অনেক খুশি। আমার বিশ্বাস কেউ কষ্ট করলে তার ফল আল্লাহ পাক দেবেন।’

তার মা ময়না বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের জন্মের পর থেকে আমার সংসারে খুব অভাব ছিল। ঠিকমতো ভাত খেতে পারি নাই। জামা কাপড় দিতে পারি নাই। খুব কষ্ট আছিল। অনেক কষ্ট করে ছেলে আমার লেখাপড়া করছে। মানুষের কাপড় পরে স্কুল কলেজে গেছে। আমরা দিতে পারি নাই।’

মমিনের প্রতিবেশী মিজান মিয়া বলেন, ‘নিজ চোখে দেখেছি, মমিনুর ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। তার কষ্টের শেষ ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল ভালো কিছু করার। সে আজ সফল হয়েছে। কলেজে ইংরেজি বিষয়ে প্রভাষক হয়েছে। আমরা দোয়া করি, তার কাছ থেকে যেন মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারে।’

কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘মমিনুর ইসলাম সারাদেশের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে এখন ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছে। সে আমাদের কলেজের ছাত্র, সে কুড়িগ্রামের গর্বিত সন্তান। সে শিক্ষাজীবনে রিকশা চালিয়ে পড়াশোনা করেছে। আমাদের কলেজের পক্ষ থেকে যেটুকু পারছি সাহায্য সহোযোগিতা করেছি। সে সাফল্য লাভ করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। কুড়িগ্রামের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছে। আমরা মনে করি, মমিনুরকে দেখে আমাদের এই অঞ্চলের দরিদ্র পীড়িত শিক্ষার্থীরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে।’

দিনমজুর থেকে ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হয়ে সমাজে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মমিনুর রহমান। শৈশব থেকে ছেঁড়া জামা কাপড়, ছেঁড়া জুতা পরে, পেটে ক্ষুধা নিয়ে পড়াশোনা করা মেধাবী মমিনুর সবাইকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাবেন বলে প্রত্যাশা সচেতন ব্যক্তিদের।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের শিক্ষক আত্মগোপনে দায়িত্বে ছাত্ররা - dainik shiksha শিক্ষক আত্মগোপনে দায়িত্বে ছাত্ররা ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029139518737793