একসময় আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ হতো। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা হতো। প্রান্তিক পর্যায়ে চৈত্র মাসে খাদ্য সংকট এমনভাবে দেখা দিতো কোনো কোনো পরিবার খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতো। আবার অনেকে চালের সঙ্গে আলু মিশিয়ে রান্না করে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কেউ কেউ একবেলা রুটি বাকি দুবেলা ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করতো। এমনকি অমুকের ঘরে আজকে চুলা জ্বলেনি এমন কথাও শোনা যেতো। মানুষের কাছে তখন খেয়ে পরে বাঁচা অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। ফলে দুর্ভিক্ষ শব্দটিও মানুষের খাদ্য সংকট তথা জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত ছিলো। কোথাও খাদ্য সংকট দেখা দিলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হতো। রুচিরও যে দুর্ভিক্ষ হতে পারে এমনটা তখনকার মানুষেরা চিন্তাও করতে পারতেন না। সময়ের পরিবর্তনে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে হয়তো এসব শুনে গল্পের মতো মনে হবে। সেইসব দিনের কথা এখনকার প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসও করতে চাইবে না।
কারণ, সেই অভাবের সময় এখন আর আমাদের দেশে নেই। এখন আমাদের দিন পাল্টেছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল হয়েছে। এক সময়ের তলা বিহীন ঝুড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে চিত্রটি উপরে তুলে ধরলাম তা খুব বেশি দিন আগের নয়। নব্বই দশকেও এমনটা দেখা যেতো। বর্তমানে মানুষের জীবন মান বেড়েছে। মানুষের সক্ষমতা, ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ফলে এখন আর উত্তরবঙ্গে মঙ্গার কথা শোনা যায় না, পত্রিকার পাতায় এখন আর লবণ দিয়ে কচু শাক সিদ্ধ করে খাওয়ার ছবিও ছাপা হয় না। একইভাবে চৈত্র মাসের সেই অভাব অনটনের কথাও এখন আর শোনা যায় না কিংবা বর্তমানে কোনো কবিকে লিখতে দেখা যায় না ভাত দে হারামজাদা না হয় মানচিত্র খাবো। যে উত্তরবঙ্গে সংবাদপত্র যেতো প্রকাশের একদিন পরে সেখানে যমুনা সেতু হওয়ার ফলে ওই অঞ্চলে উৎপাদিত ফসল এখন সকালে জমি থেকে তুলে বিকালেই চলে আসছে ঢাকাসহ সারা দেশে। এদিকে পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যে হাওরে একসময় শুকনার দিনে পাউ (পা) বর্ষার দিনে নাউ (নৌকা) ছিলো যোগাযোগের মাধ্যম। সেখানে এখন পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো রাস্তা নির্মিত হয়েছে। সত্যিই আমাদের দেশে অর্থনৈতিকভাবে একটা মারাত্মক পরিবর্তন কিন্তু সাধিত হয়েছে।দলমত নির্বিশেষে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সব সেক্টরে প্রযুক্তির ছোঁয়া এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশ এখন ফোর-জি থেকে ফাইভ-জি’র দিকে এগোচ্ছে। প্রযুক্তির এই যে অগ্রযাত্রা এটা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এবং যুগোপযোগী। প্রযুক্তি শুধু যে কাজকে সহজ করে দিয়েছে তা নয় বরং দেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের ছেলে মেয়েরাও এখন ঘরে বসে ডলার ইনকাম করছে। প্রযুক্তি সেক্টরে প্রচুর ছেলে মেয়ের চাকরি হয়েছে। প্রযুক্তির ব্যাপ্তি এতোটাই বিস্তৃত হয়েছে যে একজন গ্রামের কৃষকও এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন এবং এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশের খোঁজ-খবর রাখাসহ কৃষি সেবা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে পুলিশি সহায়তা কিংবা বিভিন্ন ধরনের জরুরি সেবা গ্রহণ করছেন। এমনকি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ‘অপরাজিতা’ একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ পাঠ করার দুর্লভ দৃশ্যও অবলোকন করেছে পুরো বিশ্ব। প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ-বিদেশে যোগাযোগ করা এতোটাই সহজলভ্য হয়েছে যে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে টাকা চলে আসছে মুহূর্তের মধ্যেই। এ রকম অনেক সুবিধার কথা বলা যাবে যা আমাদের দেশ যে এগিয়েছে তার স্বাক্ষর বহন করে।
এতোক্ষণ যা লিখলাম সবই ঠিক ছিলো কিন্তু ওই যে আমরা স্কুল জীবনে পড়েছিলাম বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ। সেই প্রশ্নের মতোই আমাদেরকে এখন আবার নতুন করে ভাবতে হবে প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে কি আমরা আশির্বাদ হিসেবে গ্রহণ করবো নাকি এটাকে আমাদের জীবনে অভিশাপ হিসেবে ব্যবহার করবো। একদিকে যেমন তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঘরে বসে ডলার ইনকাম করছেন আবার সেইসঙ্গে আরেকটি অংশ প্রযুক্তিতে আশক্তির ফলে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। যেহেতু মানুষ স্বভাবজাতভাবেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। কাজেই অনলাইনে বিকৃত রুচির কন্টেন্টের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। এর ফলে অনেকটা অবচেতন মনেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের রুচির বিকৃতি তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে রুচির এই বিকৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যাতে করে রুচির দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে সারা দেশ আলোচনায় মশগুল ছিলো অথচ যে ইস্যুটি নিয়ে এতো আলোচনা হলো সেটা নিয়ে আলোচনাও এক প্রকার রুচির দুর্ভিক্ষের অংশ। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে রুচির দুর্ভিক্ষের এবারের এই উপক্রম তৈরি হয়েছে এবং এই লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। শুধু তাই নয় প্রায় দিনই আমরা সংবাদে কার সংসার ভাঙলো আর কার জোড়া লাগলো এ নিয়ে খবর দেখতে দেখতে বিষিয়ে উঠেছি। এ রকম অনেক সংবাদ আছে যা আমরা নিয়মিত দেখি সেগুলোও অনেক ক্ষেত্রে রুচির দুর্ভিক্ষের অংশ বটে। যাদের নিয়ে প্রতিদিন এতো আলোচনা-সমালোচনা হয়, টিভি খুললে কিংবা পত্রিকার পাতায় যাদের শিরোনাম করা হয় তা দেখলে সহজেই অনুমেয় হয় যে আমাদের রুচির লেভেল কোন পর্যায়ে নেমেছে। এটাও এক ধরনের রুচির মড়ক লাগার মতোই অবস্থা। আমাদের রুচিবোধ পরিবর্তন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
দুর্ভিক্ষ, সেটাও আবার রুচির! কথাটি শুনতেও আসলে কেমন জানি লাগছে। কিন্তু হালের আলোচনায় গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রুচির দুর্ভিক্ষ। যে একটি মন্তব্যের সূত্র ধরে রুচির দুর্ভিক্ষ কথাটি সামনে এসেছে সেটা মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। আমাদের বাঙালি সমাজের একটি গুরুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট ছিলো শিষ্টাচার। আমরা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের খুবই সম্মান করতাম, সমাজে একটা মান-মান্যতা ছিলো। সিনিয়ররা কোনো অন্যায় কিছু বললেও আমরা প্রতিবাদ করতাম না বরং মেনে নিতাম। এটাকে যে যেভাবেই দেখেন আমার কাছে বিষয়টার একটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। কারণ, এটাও ছিলো আমাদের বাঙালি সমাজের এক ধরনের শিষ্ঠাচার মুরুব্বীদের ওপরে কথা না বলা। ফলে সমাজে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যে ক’জন সিনিয়র এখন আমাদের মাঝে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মামুনুর রশিদ। তিনি কোট করে একটি কথা বলেছেন এবং এটাই বাস্তব। তারপরও তাকে নিয়ে যেভাবে সমালোচনা এবং ট্রল করা হলো সত্যিই দুঃখজনক।
রুচির দুর্ভিক্ষ কথাটি সাংস্কৃতিক অঙ্গন দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে তা সমাজের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। যেহেতু গাছের চেয়ে আগাছার বৃদ্ধি বেশি হয় এবং আমরা ধান ক্ষেতে যেমনটা দেখি আগাছা গুলো মূল গাছের চেয়ে লম্বা এবং দেখতে প্রত্যেকটি আগাছাকে কেমন যেন খাপছাড়া লাগে। ঠিক তেমনি সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা আগাছা গুলোও কেমন জানি প্রতিটি সেক্টরেই খাপছাড়া লাগে, মনে হয় যেন পরিবেশের সঙ্গে যাচ্ছে না। বুদ্ধিমান কৃষক সেই আগাছাকে বেশি বাড়তে দেন না। মূল গাছের সুরক্ষার জন্য সময় মতো সুন্দর করে আগাছা গুলো উঠিয়ে ফেলেন যার ফলশ্রুতিতে ফলন ভালো হয়। এ তো গেল ধান ক্ষেতের চিত্র। বর্তমানে আগাছায় ছেয়ে গেছে আমাদের চারপাশ। সমাজ-সংসার সর্বত্রই চলছে হাইব্রিড তথা উচ্চ ফলনশীল আগাছার দাপট। হাইব্রিড আগাছার দাপটে মূল গাছেরা অনেকটাই কোনঠাশা। কোন কোন জায়গায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে মূল ধারার মানুষ গুলো।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্রই আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে এই আগাছাদের উত্থান। আর এমনটা যদি চলতে থাকে এবং তা যদি সময় মতো নিড়ানি দেয়া না হয়। তবে মূল গাছেরাই একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আমাদের যে ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি কালচার তা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আমরা যদি আমাদের সেই ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই তাহলে অবশ্যই অতি দ্রুত আগাছায় ছেয়ে যাওয়া সমাজ থেকে আগাছা দূর করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন মূলধারার দেশপ্রেমিক মানুষগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা তথা মূল্যায়ন করা। প্রতিটি সেক্টরেই এক ধরনের নিড়ানি দেয়ার সময় এসেছে।
আরেকটা বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয় আমরা স্বীকার করতে চাই না যে, এই কাজটা আমাকে দিয়ে হবে না বা হচ্ছে না। আমরা এটাকে পরাজয় মনে করি এবং এই পরাজয় নিজ স্বার্থের কারণে দেশের ক্ষতি হলেও মানতে চাই না। যেটাকে আমি বলি আমাদের কোনো সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট বা আত্ম মূল্যায়ন নাই বললেই চলে। কে কোনটার যোগ্য বা উপযুক্ত সেটা নিজ বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা সবকিছুর জন্যই নিজেকে উপযুক্ত এবং যোগ্য মনে করি আদতে আমি কোনটারই যোগ্য কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে সমাজে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে হলে আমাদের রুচির পরিবর্তন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে কোনো আগাছা যেনো গজাতে না পারে সেই ব্যপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
লেখক : গাজী মহিবুর রহমান, কলাম লেখক