রুয়েটের সব অবৈধ নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখের মেয়াদে দেয়া সব অবৈধ নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি রুয়েট উপাচার্যকে দেয়া এক চিঠিতে এসব নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ৪ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মোছা. রোখছানা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিটি রুয়েট উপাচার্যকে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রমে অনিয়ম বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন নিয়োগ ও বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

যাতে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৩-এর ১০ (৩) ও ১১ (৮) ধারার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। তাই আইনের মৌখিক প্রিন্সিপাল অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গৃহীত ও সম্পাদিত কার্যক্রম শুরু থেকে বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ-সংক্রান্ত সব নিয়োগ বাতিল করার ব্যবস্থা নিতে হবে। চারজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে নিয়োগের সুপারিশ করায় এ-সংক্রান্ত সব নিয়োগও বাতিলের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ এবং আইন অনুযায়ী সিলেকশন বোর্ড গঠন না করাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে নিয়োগের ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। চিঠিতে দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে তা প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেও বলা হয়েছে।

২০১৮ সালের ৩০ জুলাই চার বছরের জন্য রুয়েটের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখ। নিয়োগ পাওয়ার পরের বছর তিনটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রুয়েটে বিভিন্ন পদে ১৩৫ জনকে নিয়োগ দেন। আর নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয় গত বছরের ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২তম সিন্ডিকেট সভায়। নিয়োগ অনুমোদনের পর অভিযোগ ওঠে, উপাচার্য স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে তার সহোদর মো. মুকুল হোসেনকে ‘সেকশন অফিসার’ ও আরেক সহোদর লেবারুল ইসলামকে ‘জুনিয়র সেকশন অফিসার’ ও শ্যালক সোহেল আহমেদকে ‘পিএ টু ডিরেক্টর’, চাচাতো বোন মাছুমা খাতুনকে ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর’, গৃহকর্মী লাভলী আরাকে ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট কুক’, গৃহকর্মী লাভলীর স্বামী এনামুল হককে ‘উপাচার্যের গাড়িচালক’ ও স্ত্রীর ফুফাতো ভাই মেহেদী হাসানকে ‘কেয়ারটেকার’ পদে নিয়োগ দেন। এছাড়া বিজ্ঞাপিত পদের চেয়ে বেশি জনবল নিয়োগ দেয়ারও অভিযোগ ওঠে।

এমন পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ মার্চ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ঘটনা অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ইউজিসির ওপর। স্বজনপ্রীতির অভিযোগের তদন্তে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার মতো অবস্থা দেখতে পায় ইউজিসির তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে গোটা নিয়োগ কার্যক্রমের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির সংবিধি অনুযায়ী, নিয়োগ কমিটির সভাপতি হবেন উপাচার্য।

তবে বহুল প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, প্রার্থীদের মধ্যে আত্মীয়-স্বজন থাকলে উপাচার্য তা ঘোষণা করে সিন্ডিকেটে অনুমোদন নিয়ে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে তার দায়িত্বে নিয়োগ দেবেন। এক্ষেত্রে রুয়েট আইনে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে দুটি জায়গায় নির্দেশনা রয়েছে। ১০ (৩০) ধারায় বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলরের পদ শূন্য হলে কিংবা ছুটি, অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে শূন্য পদে নবনিযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলর কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা ভাইস চ্যান্সেলর পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত চ্যান্সেলরের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত না থাকা সাপেক্ষে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করিবেন। আর ১১ (৮) ধারায় বলা হয়েছে, ভাইস চ্যান্সেলর তার বিবেচনায় প্রয়োজন মনে করলে তার যেকোনো ক্ষমতা ও দায়িত্ব সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে অর্পণ করতে পারবেন।

যদিও উপাচার্যের আত্মীয়-স্বজনকে যে বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়, তার প্রধান করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারকে। তবে এ দায়িত্বভার প্রদানের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের অনুমোদন নয়। যেহেতু নিয়োগ বোর্ডটি আইনসম্মত উপায়ে গঠিত হয়নি, সেহেতু ওই বোর্ড পরিচালিত নিয়োগ কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।

অবৈধভাবে রেজিস্ট্রারকে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান করার বাইরেও এ-সংক্রান্ত আরো বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি। তদন্ত প্রতিবেদনমতে, বিদায়ী উপাচার্যের মেয়াদে দেয়া ওই নিয়োগ কার্যক্রমের সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও এমপিকিউর বাইরে গিয়ে অনেককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগপত্র ইস্যু করার সময় যে রেজিস্টারে তথ্য সংরক্ষণের কথা, সেখানে নিয়োগপ্রাপ্তদের কোনো নাম বা পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া যে সিন্ডিকেট সভায় নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়, এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যদের সভার কার্যবিবরণী জানানো ও অনুমোদনের কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। বরং এক বছর পরে কয়েকটি সিন্ডিকেট সভার পর সেটি সিন্ডিকেট সদস্যদের জানানো হয়। এছাড়া নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় নানা ধরনের ঘষামাজা ও অসংগতি উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে।

নিয়োগ কার্যক্রমে উঠে আসা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এর মধ্যে উপাচার্যসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনিয়মে জড়িত থাকায় রুয়েটের রেজিস্ট্রারকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘উপাচার্যের কর্তব্য হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, সংবিধি ও বিধানের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কঠিন হলেও এমন সংকল্পে দৃঢ় থাকতে হয় উপাচার্যদের। তাহলে কোনো ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত নৈতিক নিয়ম অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকলে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ঘোষণা দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে নিয়ম মেনে অন্য কাউকে নিয়োগ করেন। এমনকি ক্লাসেও কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে সংশ্লিষ্ট কোর্সের প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নৈতিক প্রচলন রয়েছে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
২৭তম বিসিএস: বঞ্চিতদের রিভিউ শুনানি ৪ ডিসেম্বর - dainik shiksha ২৭তম বিসিএস: বঞ্চিতদের রিভিউ শুনানি ৪ ডিসেম্বর শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ড. মাহবুব - dainik shiksha শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ড. মাহবুব ঢাবিতে দেয়ালে ছাত্রদলের পোস্টার, প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ঢাবিতে দেয়ালে ছাত্রদলের পোস্টার, প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ইএফটিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সংক্রান্ত সভা ১২ নভেম্বর - dainik shiksha ইএফটিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সংক্রান্ত সভা ১২ নভেম্বর পিয়নই ইংরেজি শিক্ষক - dainik shiksha পিয়নই ইংরেজি শিক্ষক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: দশম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: দশম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023860931396484