রাখাইন রাজ্যে গত চার মাসেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মি (এ’এ)’র মধ্যে তীব্র লড়াই চলছিল। আগস্ট মাসে উত্তর মংডুতে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে এএ’র মধ্যে সংঘর্ষেরসীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে কয়েক হাজার গ্রামবাসী মংডু শহরে আশ্রয় নেয়। এ এ মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কিছু কৌশলগত ঘাঁটি দখল করে। ঘাঁটিগুলো ফের দখলের জন্য সেনাবাহিনী বিমান হামলা চালায়। এতেও ব্যর্থ হওয়ার পর সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারীর পর উত্তর মংডুর সমস্ত রাস্তায় অবরোধ আরোপ করে। সেনাবাহিনী রাস্তা ও জলপথ অবরোধের পর উত্তর মংডুর গ্রামগুলোতে খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।এর ফলে সেখানে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয় । ২৬ নভেম্বর এএ এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি হয়েছে। বেশ কয়েক দিন আলোচনার পর সামরিক বাহিনী এবং এএ রাখাইন রাজ্যে এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতির পর সেনাবাহিনী ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর মংডুতে আশ্রয় নেওয়া অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ (আইডিপি) তাদের ঘর-বাড়িতে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আরাকানে নানামুখী সহিংসতায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯০ হাজার। এই সংঘর্ষ চলাকালীন মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে প্রায় ৪০,০০০ সেনা মোতায়েন করে। ইরাবতী ডিভিশন কোস্টগার্ড, ১১ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, ২২ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনকে বুথিডং এবং মংডু শহরের উত্তর অংশে মোতায়েন করা হয়েছিল। রাখাইন অঞ্চলে মোতায়ন রয়েছে ৭৭ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। পালেতোয়া এবং কিউকতাও টাউনশিপের মধ্যে দক্ষিণ পালেতোয়া এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে ৫৫ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। এই ডিভিশনগুলো ইয়াঙ্গুন অঞ্চল, বাগো অঞ্চল, দক্ষিণ শান রাজ্য এবং কারেন রাজ্য থেকে এসেছিল। এর পাশাপাশি ১৯ সামরিক অপারেশন কমান্ড উত্তর পালেতোয়াতে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে। রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য এ এ’র সাথে সংঘর্ষের সময় বেসামরিক এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠী উভয়কে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার কারণে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। চলমান যুদ্ধের কারণে রাখাইন জনগণ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা সমাধানের জন্য ।মানবিক কারণে এ এ এই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা গেছে। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বিরতি চলছে।
নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইয়োহেই সাসাকাওয়া এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন। ইয়োহেই সাসাকাওয়া মায়ানমারে জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য জাপানের বিশেষ দূত। তাঁর নিপ্পন ফাউন্ডেশন জনহিতকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত এবং এই সংস্থা জাপান এবং বিদেশে বিভিন্ন ধরনের মানবিক সহায়তা প্রদান করে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এই যুদ্ধবিরতির পর দেশের অন্যান্য অংশ থেকে রাখাইনে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া শুরু করেছে । ফলে রাখাইনের পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে চুক্তি ভঙ্গ করলে যে কোনো সময় আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতার আগেও সফল হয়েছিলেন এবং অনেক বড় মানবিক বিপর্যয় থেকে রাখাইন রাজ্য রক্ষা পেয়েছিল। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইনের কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়ে তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এর কিছুদিন পরই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে এ এ’র তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় দুই বছর ধরে এই সংঘর্ষ চলে এবং এর ফলে উভয় পক্ষে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের আগে সামরিক বাহিনী এবং এ এ এর মধ্যে একটি সফল অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছিলেন সাসাকাওয়ার। নির্বাচনের আগে তিনি উত্তর রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন করেছিলেন এবং তার সক্রীয় ভূমিকায় রাখাইন রাজ্যের নয়টি টাউনশিপ নির্বাচনে অংশ নেয়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং এএ’র মধ্যে চলমান সহিংসতা ও সংঘর্ষের কারণে সেখানকার বাসিন্দাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাতিল করেছিল কর্তৃপক্ষ। ২০২০-তে নির্বাচনে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আসনে এনএলডি বেশ কিছু আসন লাভ করলেও রাখাইনে তাদের জনপ্রিয়তা কম থাকায় এই রাজ্যে ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকান (ইউ এল এ) সব আসনে জয়লাভ করে ইউএলএ’র সশস্ত্র সংগঠনই এ এ । ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ এ রাখাইনে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করে জনসেবা প্রদানের জন্য নিজস্ব একটি প্রশাসনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, একই সাথে তারা একটি বিচার বিভাগ এবং পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে। এরপর থেকে এ এ মিয়ানমার শাসনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল। ফলে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসে এ এ এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং আগস্ট থেকে উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য এবং প্রতিবেশী চীন রাজ্যের পালেতোয়া টাউনশিপে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। বর্তমান এই অস্ত্র বিরতির পূর্ব পর্যন্ত এই সংঘর্ষ চলমান ছিল। সংঘর্ষের কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে বেশ কয়েক মাস ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছিল এবং সীমান্তে গোলাগুলির পাশাপাশি হতাহতের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল। এই যুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হতাহতের শিকার হওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু ঘাঁটি হাতছাড়া হয়। বেসামরিক নাগরিকরা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং নির্দিষ্ট জনপদে খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ ব্যবস্থায় অবরোধের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে রাখাইন রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলার কারণে কৃষকদের ফসল সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ায় রাখাইনে মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দেয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। যুদ্ধবিরতির পর দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর সিতওয়ে-রাথেডং-বুথিডাং জলপথটি চালু হয়েছে এবং উত্তর মংডুর কিছু রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেয়া হয়েছে। তবে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোন পক্ষই তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়নি ।
সাসাকাওয়ার নেয়া এই মহতি উদ্যোগ প্রশংসার দাবী রাখে। তাঁর মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিসরে জাপানের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে, যা জাপানের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটা ইতিবাচক পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ও আসিয়ান মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়েছে। মিয়ানমারের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সেনা সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে। পশ্চিমা হুঁশিয়ারিকে ও নিষেধাজ্ঞাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে অনেকে মনে করছেন। আরাকানে সাসাকাওয়ার এই ভূমিকা মিয়ানমারের অন্যান্য বিবাদপূর্ণ এলাকায়ও তাঁর মধ্যস্থতার মাধ্যমে সফলতার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যা আসিয়ানের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে জাপানের কূটনৈতিক ভূমিকার দক্ষতার প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ভূমিকাকে আরাকান ও পার্শ্ববর্তী চীন প্রদেশের পালেতোয়া এলাকার স্থানীয়রা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং এর ফলে তারা দুইবার মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
জাপানের সাথে রাখাইনের সম্পৃক্ততা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। সে সময় জাপানের আক্রমনের মুখে ব্রিটিশরা বার্মা ছেড়ে ভারতে চলে আসে। ব্রিটিশদের সাথে জাপানীদের যুদ্ধে রাখাইনরা জাপানীদের পক্ষে যুদ্ধ করে অন্যদিকে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদেরকে সমর্থন করে। আরাকান জাপানীদের দখলে আসার পর তখন একদফা রোহিঙ্গা নিধন চলে। পরে ব্রিটিশরা আবার আরাকান দখল করলে রাখাইনরা আক্রমনের শিকার হয়। রাখাইনে বহু যুগ ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সহিংসতা ও অবিশ্বাস দূর করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। এন ইউ জি-এই বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে এবং সম্প্রীতি বাড়াতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর আরাকানের মূল রাজনৈতিক সংগঠন ইউএলএ জানিয়েছে যে, আরাকানের যে কোনো বিষয়ে কোন আলোচনা বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের সাথে সমঝোতায় আসতে হবে। তারা জানিয়েছেন , রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে ইউএলএ এবং আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দিয়ে আলোচনায় বসতে হবে এবং তারা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্যান্য সংস্থাগুলোকে তাদের চলমান কার্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। একই সাথে রাখাইন রাজ্যে এন এল ডি প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও এ এ’র সাথে একত্রে কাজ করতে হবে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পাশাপাশি রাখাইনে শান্তি নিশ্চিত করা গেলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হবে। মিয়ানমার পরিস্থিতি বর্তমানে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং নতুন নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর উচিত, বিষয়টি আমলে নিয়ে নতুনভাবে কর্মপন্থা ঠিক করা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এ এ’র মধ্যে অস্ত্র বিরতির সাথে সাথে সাসাকাওয়া ও এ এ’র সাথে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত নেয়ার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলে সমস্যার একটা বাস্তবসম্মত সমাধান হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
লেখক : ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক