চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারনে বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলছে। নতুন নতুন সংকট মোকাবিলায় দাতাদের ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দের অগ্রাধিকারে পরিবর্তন আসছে এবং ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দাতারা তাদের সহযোগিতা কমালে কিংবা বন্ধ করে দিলে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সরবরাহে জটিল সংকটের সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে বাস্তব চিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করছে এবং তারা এ বিষয়ে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, বাংলাদেশের একার পক্ষে সে সমস্যা মোকাবিলা অসম্ভব। তাই এই সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা চলমান থাকতে হবে।
গত ৭ মে আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা কালে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরো তহবিল সংগ্রহ এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানান। ক্যাম্পের জনঘনত্বের কারণে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের পক্ষে সবসময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানসহ সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করেছে, সেখানে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। আইওএম রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য কোনোভাবেই যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
দাতা সংস্থা নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাসাকাওয়া ইয়োহেই এপ্রিল মাসে ভাসানচর পরিদর্শনের সময় রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে মাছ চাষ ও রোহিঙ্গা যুবকদের দক্ষতা উন্নয়নে ওপর গুরুত্বারোপ করে। নিপ্পন ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জেলেদের দক্ষতা বাড়াতে কাজ করবে। সরকারের সহায়তায় এবং ইউএসএ’র আর্থিক পৃষ্টপোষকতায়, ইউনিসেফ ও ব্র্যাক, ভাসানচরে ৩৮টি ক্লাস্টারে ১৮টি স্কুলের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ৭ শত ৯৮টি পরিবারকে বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদন এবং ৪ হাজার ২ শত পরিবারকে সবজি চাষে সহযোগিতা দিচ্ছে। এসব কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯ শত ৫০ জনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাসিক আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নয়ন ঘটেছে। ভাসানচরে বর্তমানে ৮ হাজার ২২২টি রোহিঙ্গা পরিবারের ৩৫ হাজার ২৬ জন সদস্য বসবাস করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি অ্যাম্বাসেডর জেফরি প্রেসকট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গাদের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা হিসেবে ৩০ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দেয়। গত ৯ মে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এই বরাদ্দের বিষয়ে জানায়। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং এ সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত আশ্রয়দানকারী বাংলাদেশিদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকার এবং তাদের অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জেফরি প্রেসকট রোহিঙ্গা ও তাদের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে এবং সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং গত ২২ মে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সে সময় ক্যাম্পের চলমান সেবা কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পানীয় জলের সংকট, নারী-শিশুদের দুর্ভোগ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত-লড়াই এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নানা দিক সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হয়। পেনি ওং রোহিঙ্গাদেরকে টেকসই ও নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের পাশে থাকবে ও রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা কার্যক্রমে অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতাও অব্যাহত রাখা হবে বলে জানায়।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট কেট ফোর্বস ৪ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফিল্ড হাসপাতাল এবং কক্সবাজারে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চলমান মানবিক কার্যক্রম পরিদর্শন করে। ৬ জুন কারিতাস ইন্টারন্যাশনালিজের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যালিস্টার ডাটন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গাদের জন্য শক্তিশালী মানবিক অবস্থান এবং চলমান সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ এবং বিশ্ববাসীকে তাদের জন্য আরো সহায়তার আহ্বান জানায়। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে কারিতাস রোহিঙ্গাদের জন্য ৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদানের পরিকল্পনা করছে।
ডব্লিউএফপি কার্যক্রমের বাংলাদেশ প্রধান ডমেনিকো স্কালপেলি রোহিঙ্গাদের মৌলিক প্রয়োজন ও জীবনব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করার কথা জানায় যাতে তারা অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণে আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা কমছে, চাহিদা অনুযায়ী অর্থ সহায়তা পাওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চাপে রয়েছে। পর্যাপ্ত সাহায্য না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। রোহিঙ্গারা তাদের প্রয়োজন মেটাতে কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে স্থানীয় জনগণের ওপর ঋণাত্বক প্রভাব তৈরি করেছে যা মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ, দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো সাহায্য সংগ্রহে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তবে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা ক্যাম্প পরিদর্শন করে এর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা সংকটের অগ্রগতি অবহিত করে যাচ্ছে। দাতা দেশ ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন থেকে যেসব বিষয় আমাদের সামনে এসেছে সেগুলো থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি। রোহিঙ্গাদের ত্রান সাহায্য বন্ধ করে দিলে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে তা কি করে সামলাতে হবে তার কোনো রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি। এই বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কার্যকরী প্রস্তুতি নিতে হবে।
কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর জনঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে এখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা গেলে এই সংকট কিছুটা কমবে। বাংলাদেশের একার পক্ষে এটা বহন করা সম্ভব না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় সাধ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যয় বহনের জন্যও দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর থেকে কোন আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।মিয়ানমার সেনাবাহিনী দখলকৃত এলাকাগুলোতে আক্রমণের তীব্রতা বাড়ালে সংকট আরো বাড়তে পারে। চলমান সংকটের রাজনৈতিক সমাধান এখনো দেখা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট ও জাতিগত সংঘাত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে যুদ্ধ, রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে উভয়পক্ষের ব্যবহার এবং খাদ্য সংকটের কারণে রাখাইনের পরিস্থিতি দিনদিন আরো খারাপ হচ্ছে। খাদ্যের অভাবে সৃষ্ট মানবিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ।
এএ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এএ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। এএ’র সঙ্গে যোগাযোগ ও রোহিঙ্গাদের রাখাইনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং চলমান সংকটে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআর ভারত ও চীনকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করে সংকটের সমাধানে উদ্যোগী হতে পারে। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলায় দ্রুত একটি ইতিবাচক ফলাফল আসবে এবং এর ফলে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি হবে, একইসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীনকে যুক্ত করলে এই সংকটের সমাধান সম্ভব বলে বাংলাদেশ মনে করে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম চলমান রেখেছে এবং কূটনৈতিক ও আইনি দুই প্রক্রিয়াতেই এগোচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করছে এবং একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশ আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য, রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত নিরসন ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এবং অন্যান্য অংশীদারদের সুসংহতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিক্ষার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বাড়াতে ছোট ছোট দল গঠন করে তাদের বিভিন্ন ট্রেড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করা হয়। এই প্রশিক্ষণ তাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে তাদের পেশাগত ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করবে। রোহিঙ্গাদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদেরকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাসাকাওয়া ইয়োহেই রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এএ’র মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিধ্বস্ত রাখাইনে মানবিক সহায়তা প্রদানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। নিপ্পন ফাউন্ডেশনের রাখাইনে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সাথে সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাখাইনে প্রত্যাবাসন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও পরবর্তীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ভুমিকা রাখতে পারে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক