আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এবার কোপাটা ‘ট্রিপল করোনা’ নামে পরিচিত। যার অর্থ ত্রিমুকুট। মহাদেশীয় শিরোপা, বিশ্বকাপের পর আবার মহাদেশীয় শিরোপা জিতলেই নিশ্চিত এই ত্রিমুকুট। সোমবার মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে এই ত্রিমুকুট এনে দিলেন লাওতারো মার্টিনেজ। কলম্বিয়ার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ডি মারিয়ার বিদায়ী ম্যাচে ১১২ মিনিটে গোল করেন লাওতারো। তার গোলেই কোপা আমেরিকায় টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হল লিওনেল মেসির দল। এতে স্পেনের পর এই ত্রিমুকুট জেতা দ্বিতীয় দল এখন আর্জেন্টিনা। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে কোপা আমেরিকা, ২০২২ বিশ্বকাপ ও ২০২৪ কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতলো আলবিসেলেস্তরা। এছাড়াও টানা দু’বার কোপা জিতে রেকর্ড ১৬ বার কোপা জেতার নজিরও তৈরি করল আর্জেন্টিনা।
দর্শক হাঙ্গামার কারণে প্রায় ৮২ মিনিট পর শুরু হয় আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়ার হাইভোল্টেজ এই ফাইনাল। খেলা শুরু হবার অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগে খুলে দেয়া হয় স্টেডিয়ামের গেট। সেখানে দেখা যায় অসংখ্য কলম্বিয়ান সমর্থক বিনা টিকিটে প্রবেশের চেষ্টা করে। এর ফলে সেখানে হট্টগোল বাধে। প্রটোকল অবশ্য পুরোপুরি মানতে পারেননি হার্ড রক স্টেডিয়ামের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশেরা। কলম্বিয়ান ভক্তদের অনেকেই ঢুকে পড়েন বিনা টিকিটে। পুরো বিষয়টি নিয়েই সেখানে তৈরি হয় জটিল পরিস্থিতির। এক পর্যায়ে পুলিশ এসে গ্যালারিতে প্রবেশ করার গেটগুলো বন্ধ করে দেয়।
শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের প্রথমার্ধে দুই দলই সমানে সমান লড়লো। আর্জেন্টিনার থেকে কলম্বিয়া বেশি সুযোগ তৈরি করলেও বল জালে জড়াতে পারেনি। আর্জেন্টিনা প্রচুর মিস পাস করেছে প্রথমার্ধে। বলও দখলে রাখতে পারেনি সেভাবে। প্রথমার্ধে ৫২.২ শতাংশ বলের দখল ছিল কলম্বিয়ার কাছে। তারা শট নিয়েছিল ৮টি। তার মধ্যে ৪টিই ছিল অন টার্গেটে। কর্ডোবা, রদ্রিগেজ ও লার্মার নেওয়া শট অল্পের জন্য মিস হয়। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা শট নিয়েছিল মোটে ৩টি। তার মধ্যে মাত্র ১টি ছিল অন টার্গেটে। আর্জেন্টিনা কর্নার পেয়েছিল ৪টি, কলম্বিয়া ১টি।
ম্যাচের শুরুতেই সুযোগ পেয়েছিলেন জুলিয়ান আলভারেজ। মন্টিয়েলের ক্রস বক্সের মধ্যে পান আলভারেজ। তার নেওয়া শট পোস্টের দূর দিয়ে চলে যায়। এরপর ষষ্ঠ মিনিটে লুইস দিয়াজ সুযোগ পেয়েছিলেন গোলের। তার নেওয়া নিচু শট আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক মার্টিনেজ ধরে ফেলেন। সপ্তম মিনিটে গোলের দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েছিলেন হামেস রদ্রিগেজ। কিন্তু তার নেওয়া শট বারে লেগে ফিরে আসে।
প্রথম ২০ মিনিট সেভাবে দেখা যায়নি মেসিকে। ২০ মিনিটের মাথায় প্রথমবার দলগত আক্রমণ করে আর্জেন্টিনা। বক্সে ঢুকে শট মারেন মেসি। যদিও ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষকের যৌথ প্রচেষ্টায় তা আটকে যায়। ৩০ মিনিটের পরে আরও কয়েকটি সুযোগ তৈরি করে কলম্বিয়া। আর্জেন্টিনার গোলের নিচে থাকা এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে পরাস্ত করা সহজ ছিল না।
প্রধমার্ধের বিরতির পর প্রায় ৩৩ মিনিট পারফর্ম করেন কলম্বিয়ান পপ তারকা শাকিরা। তার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হন মাঠে উপস্থিত ৬৫ হাজার দর্শক। শাকিরার পারফরম্যান্সের পর শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধের খেলা।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চালায় দুই দল। ৪৮ মিনিটে ম্যাক অ্যালিস্টার সুযোগ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাকে গোল করতে দেননি কলম্বিয়ার রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা। ৫৮ মিনিটে গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন ডি মারিয়া। এ সময় তার নেওয়া শট দারুণ দক্ষতায় ধরে ফেলেন কলম্বিয়ার গোলরক্ষক কামিলো ভার্গাস।
ম্যাচের ৬৬ মিনিটে মাঠ ছাড়েন লিওনেল মেসি। মাঠের চিকিৎসার পর আর্মব্যান্ড তুলে দেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার কাছে। মেসির পরিবর্তে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন নিকো গঞ্জালেস। সাইডবেঞ্চে বসেই এরপর কান্নায় ভেঙে পড়েন মেসি। বোঝা যাচ্ছিল, ফাইনালে খেলতে না পারার যন্ত্রণা তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। মেসি ওঠার পরে কাঁদতে দেখা যায় আর্জেন্টিনার সমর্থকদেরও। নিশ্চিতভাবেই লিওনেল মেসির জন্য এটি ছিল শেষ কোপা আমেরিকা।
খেলা যত গড়াচ্ছিল, তত উত্তেজনা বাড়ছিল। শারীরিক ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনার ছন্দ ভেঙে দিচ্ছিল কলম্বিয়া। তার মাঝেই ৭৫ মিনিটের মাথায় গোল করেন মেসির পরিবর্তে নামা নিকো গঞ্জালেস। কিন্তু অফসাইডে সেই গোল বাতিল হয়। ৮৭ মিনিটের মাথায় আবার একটি সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। এবারও গোল হয়নি। এতে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকল ম্যাচ। ম্যাচ গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে।
অতিরিক্ত সময়ের অনেকক্ষণ গোল না হওয়ায় খেলা ধীরে ধীরে টাইব্রেকারের দিকে এগোচ্ছিল। হতাশা আরও বাড়ছিল আর্জেন্টিনা দলে। ঠিক তখনই জাদু দেখালেন লাওতারো মার্টিনেজ। ১১২ মিনিটের মাথায় লো সেলসোর পাস ধরে বক্সে ঢুকে গোলরক্ষককে পরাস্ত করে গোল করেন লাওতারো। তারপর সোজা ছুটে যান মেসির দিকে। আর্জেন্টাইন মহাতারকা জড়িয়ে ধরেন ফাইনালের গোলস্কোরারকে। মেসিকে দেখে মনে হচ্ছিল, প্রাণ ফিরে পেয়েছেন তিনি।
খেলার বাকি সময় আরও মারামারি হল। বিশেষ করে গোল শোধ করার জন্য শারীরিক শক্তি ব্যবহার করছিলেন কলম্বিয়ার ফুটবলারেরা। তাতে কাজের কাজ হয়নি। লাওতারোর করা একমাত্র গোলে কোপা জিতে মাঠ ছাড়ে আর্জেন্টিনা।