বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
তাদের গ্রেফতারে গঠন করা হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ দল। তারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। সেই সঙ্গে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই প্রতিরোধে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ঢাকা শহরকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলাদা দল অভিযান পরিচালনা করছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন, রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকা বা ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন চলছে।
সংশ্লিষ্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই ও আগস্টে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো অধিকাংশকে এরই মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ফুটেজের পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের নাম-পরিচয় বের করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে যারা অবৈধভাবে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। অস্ত্র ব্যবহারকারী ও জোগানদাতা উভয় গ্রুপকে খোঁজা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অস্ত্রধারীর সংখ্যা একশর বেশি হবে। আইনের আওতায় আনার স্বার্থে এখনই সবার নাম-পরিচয় প্রকাশ করছি না। ডিবির টিম তাদের ধরতে অভিযান শুরু করেছে।
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনার আলোকে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের ধরতে দিন-রাতে বিশেষ টহল থাকছে। গোয়েন্দা পুলিশের বিভিন্ন টিম নির্ধারিত এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে কোনো অপরাধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ালে কোনো ছাড় পাবে না।
সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ২ আগস্ট উত্তরার জমজম টাওয়ার এলাকায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন অস্ত্রের মহড়া দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকজন অস্ত্রধারী ছিল। ৪ আগস্ট উত্তরার আজমপুর এলাকায় অস্ত্র হাতে মহড়া দেন সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরতাফা বিন ওমর। তাদের এখনো গ্রেফতার করা যায়নি।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পিস্তল হাতে এক যুবককে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে দেখা যায়। ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সামনে ওই ঘটনা ঘটে। ওই অস্ত্রধারীর নাম হাসান মোল্লা। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এবং ঢাকা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া ঢাকার আরো অন্তত তিনজন সাবেক কাউন্সিলর ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন এবং অস্ত্রের মহড়া দেন।
৫ আগস্টের পর এখনো দেশের অনেক থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। যানবাহন সংকটের পাশাপাশি টহল ও প্যাট্রল নিয়মিত করা যাচ্ছে না। অপরাধীদের গ্রেফতারেও থানা পুলিশ স্বাভাবিক গতিতে কাজ করতে পারছে না। ফলে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের টিমকে আরো গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছে।
ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গাঢাকা দেয় তারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে ঢাকার যে কয়েকটি এলাকায় সবচেয়ে বেশি গুলি করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, রামপুরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডি, বছিলা ও গুলিস্তান। সেখানকার সিসি ক্যামেরা ও ভাইরাল হওয়া ভিডিও বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাজধানীসহ দেশের যেসব এলাকায় গুলির ঘটনা বেশি ঘটেছে, প্রযুক্তিগত তদন্তে তাতে জড়িতদের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। অস্ত্রধারীদের কেউ দেশ থেকে পালিয়েছে। আবার অনেকে বিভিন্ন এলাকায় গাঢাকা দিয়েছে। ডিবির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের ধরতে বিভিন্ন জেলায় চলছে অভিযান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন দেশজুড়ে বিস্তৃত হতে শুরু করলে তা দমানোর চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ সরকার। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও সম্প্রতি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। তারা বৈধ-অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়লে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা হতাহত হন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করে পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় সিসিটিভি ফুটেজ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি-ভিডিও, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্য-ছবি বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধান করা হয়। এতে এখন পর্যন্ত গুলি ছোড়ায় জড়িত শতাধিক নেতাকর্মীর তথ্য মিলেছে। দ্রুতই জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশা করছে ডিবি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রিফাত রশীদ বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগসহ অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারের আওতায় আনতে হবে। শুধু জুলাইয়ের সময়ে নয়, আগেও যারা নানা নির্যাতন-নিপীড়ন, নানা অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত ছিল, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের আইনের আওতায় আনলে দেশ নিরাপদ হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
যত গ্রেফতার
আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন স্থানে গুলি ছুড়ে হত্যায় জড়িত অনেককেই এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী রয়েছেন। গত দুই মাসে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে রাঘববোয়ালসহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়ায় জড়িত অনেকে।
সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে শনিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি। এদিন ভোরে ডিবি শেখ পরিবারের সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে মঈন আবদুল্লাহকে গুলশান-২ থেকে গ্রেপ্তার করে। শনিবার ছাত্রলীগের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল শাখার সভাপতি খাদিজা আক্তার ঊর্মি ও সূর্য সেন হল শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোয়াজ্জেম এইচ রাকিব সরকার। রাজধানীর মিরপুর থেকে সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং বনানী থেকে সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
এর আগে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাহিত্যবিষয়ক উপসম্পাদক আজহারুল হক ফরাজী, বাড্ডায় জিল্লুর রহমান শেখ হত্যা মামলায় স্থানীয় দুই নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
ছিনতাই-ডাকাতি ঠেকাতে তৎপরতা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে বেপরোয়া চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পরে তা কিছুটা কমে এলেও সাম্প্রতিককালে আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
এর মধ্যে মোহাম্মদপুর অপরাধীদের জন্য কার্যত অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি অন্যান্য এলাকাতেও এমন ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ডিবি। নগরের অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে আলাদা আলাদা দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক টহল-নজরদারি করছে। সেইসঙ্গে ওই এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনছে তারা।
ঢাকার কম্বিং অপারেশন
সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, কিশোর গ্যাং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযান জোরদার করার জন্য পুলিশের সব ইউনিট-প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। গতকাল এক বিশেষ বার্তায় এ নির্দেশ দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক।
আইজিপি তাঁর নির্দেশনায় বলেন, দেশব্যাপী ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামিসহ অন্যান্য মামলার আসামিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা বা ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল প্যাট্রোল ও মোটরসাইকেল প্যাট্রোল টিম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরো বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ১৫০টি স্থায়ী ও মোবাইল চেকপোস্ট কার্যকর রয়েছে। ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে। এ ছাড়া দেশব্যাপী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধেও মামলা, গ্রেফতারসহ আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে; যা চলমান।
চলমান বিশেষ অভিযানে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, ডাকাত ২০০ জন, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ১৬ জন; বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে হামলাকারী ১ হাজার ১৪০ জন; মাদকদ্রব্য উদ্ধারসংক্রান্তে ১ হাজার ১৪৪ এবং অবৈধ অস্ত্রধারী ৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।