শিক্ষাবিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও শিক্ষাবিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমে ‘ভারতে পাঠ্যবই ছাপা আর না, টেন্ডার বাতিল’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি লিড নিউজ ছাপা হয়েছে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর)। এই সংবাদের কয়েকটি মেরিট বা গুণ আমাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছে। তাই এই লেখা।
প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জগুলো অত্যন্ত সাহসিকতা, ধৈর্য এবং পেশাগতভাবে তারা একটার পর একটি মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। আমরা জানি, এই সরকারে যারা আছেন তারা রাজনীতিবিদ নন, রাজনীতির কূটচাল তারা কখনো চালেননি, তাই অনেকেই মনে করতেন, দেশের এতো বিশৃঙ্খল অবস্থায় তারা তেমন কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু, আমরা দেখলাম অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে তারা বাঁধাগুলো একে এক উতরে যাচ্ছেন এবং মানুষের কাম্য বিষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
কারিকুলাম নিয়ে, মহা সংকটে দেশ, কোনো কথায়ই কর্ণপাত করেনি পূর্বের সরকার যা মনে করিয়ে দেয়, এরসাথে শিক্ষা নয়, বাণিজ্যের এবং রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয় গভীরভাবে প্রোথিত। তাই দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে, তাদের মতামতকে পাত্তা না দিয়ে কারিকুলাম তারা বাস্তবায়নই করবেনই।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসে প্রথমেই সেটিতে হাত দিলেন এবং বললেন, কারিকুলামে প্রয়োজনীয় সংষ্কার করা হবে এবং আগামী ২০২৫-এর জানুয়ারিতে পরিমার্জন করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে। ইতিমধ্যে বইয়ের টেন্ডার হয়ে গেছে। সেটিকে ফেরানো বা বাতিল করা চাট্টিখানি কাজ নয়। আমরা (দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা) যেহেতু জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবন্ধ শিক্ষার সমস্যা তুলে ধরে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং জাতির জন্য কল্যাণকর কিছু করা। আমরা বিষয়টি সরকারকে জানালাম, বাতিল কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আরও এক বছর ভুগতে হবে কেনো? সরকার অত্যন্ত দ্রততার সঙ্গে এবং সুবিবেচনাসম্মতভাবে আমাদের লেখায় গুরুত্ব দিলেন এবং দুরূহ কাজটি করলেন অর্থাৎ পূর্ববর্তী টেন্ডার বাতিল করে ২০২৫-এর জানুয়ারিতে ষষ্ঠ থেকে নবম পর্যন্ত সবার জন্যই নতুন বই পূর্ববর্তী কারিকুলাম অনুযায়ী (তথাকথিত নতুন কারিকুলামে নয়) শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়ার ঘোষণা দিলেন। টেন্ডার বাতিল হয়েছে, পূর্ববর্তী কারিকুলামে বই তৈরির কাজ চলছে। সাবাশ!
এরপরে, শোনা গেল প্রাথমিকের কারিকুলামের এক কোটি বই বই ভারতে ছাপা হবে। নৈতিকভাবে বিষয়টি সমর্থন করা যায় না বিধায় দেশব্যাপী বিষয়টির ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায় এবং ৯২ শতাংশ মানুষ বিষয়টি সমর্থন করেন না। তাই, পত্রিকা দুটোতে আবারও ছাপা হলো ‘বাংলাদেশের পাঠ্যবই ভারতেই কেনো ছাপাতে হবে’। সেখানে বলা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি রিস্ক নিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে বইয়ের পুরনো টেন্ডার বাতিল করতে পারে তাহলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেনো পারবে না? আমরা জানতে পারলাম যে, এটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার, আন্তর্জাতিক বাইডিংয়ের মাধ্যমে ভারতের ‘প্রিতম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড’ এবং ‘পাইওনিয়ার প্রিন্টার্স’ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার বই ছাপার কাজ পেয়েছে। এই আন্তর্জাতিক টেন্ডার বাতিল করা সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছিলেন। আমরা আরো বলেছিলাম যে, দেশের প্রিন্টিং এবং পাবিলিশিং ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হবে, রক্ত সঞ্চার করতে হবে। আমরা কোনো রাজনৈতিক সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারি না কিন্তু আশায় ছিলাম যে, এই সরকার সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দেশবিরোধী কোনো কাজ করবে না। আমাদের সেই আশা বাস্তবে রূপ নিলো। শুধুই দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষায় যখন জানলাম, সেই আন্তর্জাতিক টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এটি নিতান্তই বড় সাহসের কাজ, দেশপ্রেমমূলক কাজ, পেশাদার কাজ, দক্ষতার কাজ এবং দুর্নীতি বিরুদ্ধ কাজ! সরকারকে আবারও বিরাট ধন্যবাদ।
রাজনৈতিক সরকারগুলো শুধু কথায় কথায় জনগণের কথা বলে, দেশের কথা বলে আর কাজ করে সম্পূর্ণ উল্টো। তাদের অনেক কাজ জনগণ এবং দেশের স্বার্থবিরোধী। তাই, আন্তর্জাতিক টেন্ডার বাতিল করা মানে মহান দেশপ্রেমের পরিচয়! দেশপ্রেম, দেশ ও জনগণের কথা বলে পূর্ববর্তী সরকারগুলো গলার রক্ত উঠিয়ে ফেলতো, মুখে ফেনা তুলে ফেলতো কার কাজ করতো দেশদ্রোহীর। এই সরকারের কাজ ও কথার মিল দেখে জনগনের আশা আরো বেড়ে যাচ্ছে যে, দেশে অবশ্যই ভালকিছু হতে যাচ্ছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নামে একটি মারাত্মক ফাঁকাবুলির কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব ও দীপু মনি লাখোবার এই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করেছেন। অথচ আমাদেরকে দুর্নীতির মহাসাগরে ভাসানো হয়েছে সেই বুলি আওড়াতে আওড়াতে। ভারতে বই ছাপতে দেয়া শুধু দেশপ্রেমহীনতার কথাই বলে না, এখানে দুর্নীতির গন্ধ এবং সংশ্রব রয়েছে। তা না হলে এ কাজ হতে পারে না, যেখানে দেশের প্রিন্টিং শিল্প দাঁড়াতে পারছে না অথচ বিদেশে আমরা বই ছাপতে দিচ্ছি! দৈনিক শিক্ষাডটকম এবং দৈনিক আমাদের বার্তা এ বিষয়টিতেও গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং দুর্নীতির অনেক তথ্য জানা গেছে। সেই দিক থেকেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এতো কথা না বলে সরাসির অ্যাকশনে যাচ্ছে।
দৈনিক শিক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে প্রতিবছরই ভারতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠ্যবই ছাপানো হতো। বোঝাই যাচ্ছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পকেট ভারী করার এটিও ছিলো আরেকটি মাধ্যম। দুই ভারতীয় প্রকাশকে সেই ধারাবাহিকতায় সরকারের শেষ পর্যায়ে এসেও ১৮টি লটে বই ছাপাতে দেয়া হয়েছিলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই টেন্ডার বাতিল করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হওয়া দেশবিরোধী ট্রাডিশন অর্থাৎ আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের পাঠ্যবই ভারতে ছাপানোর ইতি ঘটলো। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই এভাবে সব ধরনের দেশবিরোধী এবং জনস্বার্থবিরোধী কাজ বন্ধ হবে ও দুর্নীতির কবর রচিত হবে বর্তমান সরকারের হাতে।
লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক