শিক্ষক নির্যাতন রুখতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

জীবন ও জগতকে জানবার অপরিসীম আগ্রহই মানুষকে বিশ্বচরাচরে মহিমামণ্ডিত করে তুলেছে। জ্ঞানবিশ্ব সীমান্তহীন। বিচিত্র তার শাখাপ্রশাখা। একজন মানুষের পক্ষে সকল শাখা-প্রশাখায় বিচরণ কঠিন। যে যার আগ্রহের তীব্রতা অনুযায়ী বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হন। কোনো বিষয়ে যিনি তুলনামূলকভাবে বেশি জানেন, তাঁর কাছ থেকে অন্যরা তা জেনে নিতে চান। যিনি শেখান তিনি শিক্ষক, যিনি শেখেন তিনি শিক্ষার্থী। মানুষ প্রকৃতি থেকেও পাঠগ্রহণ করে। তাই প্রকৃতিও আমাদের শিক্ষক। ধারণা করা যায়, সভ্যতা সৃষ্টির আগেও জ্ঞান বিনিময়ের মধ্য দিয়ে মানুষ সমৃদ্ধ হয়েছে বলেই সভ্যতার সূচনা হতে পেরেছে। প্রাকৃত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-পর্যায় পার হয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়েছে। শিক্ষকতা একটি পেশা বটে কিন্তু এখানেই তার মর্মার্থ নিহিত নয়। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকতা একটি ব্রত। একজন শিক্ষককে কেবল শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে আদর্শ হয়ে উঠতে হয়। স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন না করতে পারলে কেউ শিক্ষার্থীর কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারেন না। এ কারণেই সব দেশে সব কালে সব শিক্ষক সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত।

বিশ্বের প্রায় সব দেশে শিক্ষকের মর্যাদা বা সম্মানের যে ধারা বহমান, বাংলাদেশেও কি তাই? এদেশের শিক্ষকগণ কি তাদের প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে অতীতের কিছু কালো অধ্যায়কে জানতে হবে। সেসব কালো অধ্যায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এদেশে শিক্ষকরা বরারবারই অবহেলিত এবং ক্ষেত্রবিশেষ নির্যাতিত। কিছু কিছু পত্রিকার পাতায় আসে, তাই আমরা জানতে পারি। বাকি অনেক ঘটনাই রয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। তেমনি একটি ঘটনা ঘটে ২০০৫ সালের ১৬ জুলাই। এদিন শিক্ষকদের বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দেলনরত শিক্ষকদের শান্তিপুর্ণ মিছিলে পুলিশ বাহিনীর বর্বর হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষকনেতা গুরুতর আহত হন। এর আগে এমন ঘটনা ঘটলেও সেভাবে আলোচনায় আসেনি। এই ঘটনাটি আলোচনায় এসেও ফলপ্রসূ হয়নি। যার ফলে এরপরেও দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। চলতি বছরের ১২ অক্টোবর সারাদেশে শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।   সংগঠনের নেতারা দাবি করেন, সারাদেশে শিক্ষকদের শারীরিকসহ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। ছোটখাট ঘটনায় একতরফা তদন্ত করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই বিধিসম্মত নয়। আমরা এই অবস্থার অবসান চাই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের অসদাচরণের জন্য পাঁচ ধরনের শাস্তির বিধান আছে জানিয়ে সমাবেশে শিক্ষকরা বলেন, ‘কিন্তু অপরাধ যাই হোক সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বরখাস্তই করা হয়ে থাকে। বাকি চার ধরনের শাস্তি দিতে দেখা যায় না। কারণ বরখাস্ত করার শাস্তি মূলত স্কুল কমিটির পূর্বনির্ধারিত। আমরা এগুলো এতদিন আইনিভাবে মোকাবিলা করেছি। কিন্ত এখন যে শিক্ষক নির্যাতন হচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না। বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের নেতারা বলেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য একটি মহল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় নেমেছে। এসব ঘটনা শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে ম্লান করে দিচ্ছে। 
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে। বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জের এক ঘটনায় পুরো জাতিকে স্তম্ভিত হতে হয়। বহুল আলোচিত সেই ঘটনা কি আমরা ভুলে গেছি? হয়তো তাই? যদি ভুলেই না যাই, তাহলে নিজেদের ওপর নেমে আসা নির্যাতন নিয়ে শিক্ষকদের কেন রাজপথে নামতে হবে? এই লজ্জা কার?  ২৪ মে’র ঘটনা সারা বিশ্ববাসী জেনেছে। তারা দেখেছে ছেঁড়া শার্ট, ছেঁড়া প্যান্ট, মৃতপ্রায় চেহারার একটি ছবি। একটি আর্তনাদ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছবিটি দেখে প্রাথমিকভাবে সেই দেশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা কি হয়েছে? একটি অসভ্য এবং বর্বরতার নিদারুণ নমুণা ধারণ করে সেই ছবিটিতে। যেটা একটি দেশের জন্য চুড়ান্ত অপমানের। ছবিতে বিধ্বস্ত অবস্থায় যাকে দেখা গেছে তিনি একজন মানুষ, একজন শিক্ষক। জন্ম সূত্রে তিনি বাংলাদেশের একজন নাগরিক। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতা। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। সেই স্কুলটিও তার নিজের গড়ে তোলা। পেশাগত দিক দিয়ে তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ কয়েক দশকের। এই কয়েক দশকে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। এমনকী ঘটনার পর সরকার থেকে দুটি তদন্তকারী টিম পাঠিয়ে খোঁজ খবর করেও, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অথচ তিনি শাস্তি পেয়েছেন। কী ধরণের শাস্তি সেটা আমরা সবাই জেনেছি। শুধু তাই নয়। সেই শাস্তির ভিডিও ফুটেজও দেখেছে বিশ্ববাসী। একজন শিক্ষক কান ধরে উঠ-বোস করছে। পাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী এক রাজনীতিক। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষক নির্যাতন ঘটছে অহরহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বিচার না হওয়ার ফলে এই ধরণের নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে। এর দুই দিন পরেই মানিকগঞ্জে খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামাল হোসেনের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক সাইফুজ্জামানকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে একদল দুর্বৃত্ত। এরও আগে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মুমিনুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক অধ্যাপক মো. ফরিদউদ্দিন আহমেদকে লাঞ্ছিত ও দিগম্বর করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় সাংসদ মজিবুর রহমানের সংশ্লিষ্টার অভিযোগ ওঠে। ক্যাপ্টেন মুজিবের সংসদ সদস্যপদ বাতিল ও দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন গৌরীপুরবাসী। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ‘সামাজিক অবক্ষয়ের পোস্টার’ শিরোনামে  একটি জাতীয় দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মৈশামুণ্ডা গ্রামে ৭০ বছর বয়েসী তৈয়ব আলী মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বেঁধে মারতে মারতে দিন দুপুরে সমগ্র গ্রাম ঘোরানো হয়। এখানে অপরাধ তৈয়ব মাস্টারের নয়। তার পুত্র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাওনাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি বলে পিতাকে পুত্রের কৃতকর্মের দায় নিতে হয়েছে। তৈয়ব মাস্টারের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়, ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবর শেখ, ইউপিসদস্য আশেক আলী ও স্থানীয় মাতব্বর জড়িত। তৈয়ব মাস্টারের পুত্রবধূ রেহানা বেগম বাদি হয়ে চাঁদপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। 

নির্যাতনের এমন উদাহরণ আরও বহু আছে। স্কুলশিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সর্বক্ষেত্রে এহেন নির্যাতনের চিত্র দেখা যায়। একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্যাতনের ক্ষেত্রে যোগ হয় নতুনত্ব। আমাদের সামনে ভেসে ওঠে এমন বীভৎস দৃশ্য, যা আদিম বর্বরতাকে হার মানায়। শুধু দৃশ্য নয়। এমন অকথ্য ভাষার অডিও বার্তা আমরা শুনেছি, যেটা কোন সভ্য সমাজে কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকৃত অর্থে এই ঘটনা গুলো হচ্ছে মানবিক মর্যাদার অবমাননা এবং নাগরিকের অধিকার বঞ্চনা। এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ অতি জরুরি। এটি শুধু একজন শিক্ষকের অবমাননা নয়, এটি একজন নাগরিকের প্রতি আঘাত। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত নিদর্শন। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষক হিসেবেই মানবিক মর্যাদার দাবিদার নন, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই মর্যাদার দাবিদার। সেজন্যেই এই ঘটনাগুলো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। প্রতিবাদ যদি স্তিমিত হয়ে যায়, তাহলে এই ধরণের ঘটনা, আগেও যেমন ঘটেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগামীতেও ঘটবে। অন্যায়ের ধারাবাহিকতা যেন বজায় না থাকে, সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটি পরিবারের কর্তা যদি কোন কারণে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে সেই পরিবারটি হুমকির সম্মুখীন হয়। আর সেটা যদি হয়, প্রভাবশালী ব্যক্তির আদলে, তাহলে তো রেহাই পাওয়া দুষ্কর। সে জন্য আন্দোলনের পাশাপাশি লাঞ্ছিত শিক্ষকের পরিবারের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে রাখা আবশ্যক। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা পালন করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। আমরা আশা করব, অবিলম্বে এসব বিষয়ের আশানুরূপ সুরাহা হবে। আমরা যদি অবস্থানচ্যুত হয়ে পরাজয় বরণ করি, তাহলে কি নিজেরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারব? যে বিবেক দংশন আমাদের প্রতি নিয়ত তাড়া করছে,তার থেকে মুক্তি মিলবে কবে? এসব ঘটনার বিচার হয় না বলেই নতুন নতুন ঘটনা, দূর্ঘটনার জন্ম হয়। অপরাধীরা অপরাধ করার সাহস পায়। 

লেখক : শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, সিনিয়র সাংবাদিক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044341087341309