শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকের বাণিজ্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বহু লেখালেখি বহু প্রতিবেদন বহু তদন্তের পরেও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে দুর্নীতি কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। যেই মাত্র ঘোষণা করা হয়েছে যে, বত্রিশ হাজার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে; সঙ্গে সঙ্গে আগাম দুর্নীতি শুরু হয়েছে। নিলাম ডাকার মতো এবার শিক্ষকের চাকরির জন্য ঘুষ নির্ধারিত হয়েছে সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা। এটি আবার কোনো গোপন বিষয় নয়, গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে সর্বত্র দালালরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং পাঁচ লাখ টাকায় চাকরি ফেরি করছে। তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ জেলা প্রাথমিক অফিস, স্থানীয় সাংসদ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার খুবই 'সৎ'। চাকরি না হলে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করছে এবং অতীতে ফেরতও দিয়েছে। 

অতীতের একটি ঘটনা আমার মনে আছে। এক ভদ্রলোকের দুই মেয়েই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের জন্য পরীক্ষার্থী। বড় মেয়ে মেধাবী ছাত্রী, ছোট মেয়ে একেবারে সাধারণ। ভদ্রলোক দুই মেয়ের জন্যই টাকা খরচ করতে রাজি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কী করব? আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, যেহেতু আপনার বড় মেয়ে মেধাবী এবং ছোট মেয়ে সাধারণ তাই অন্তত একটা মেয়ের চাকরি হোক। কিন্তু ভদ্রলোক বড় মেয়ের ব্যাপারে আমার কথা শুনলেন, টাকা খরচ করলেন না। কিন্তু ছোট মেয়ের জন্য টাকা খরচ করলেন এবং সে চাকরিও পেয়ে গেল। বড় মেয়েটির চাকরি হলো না, এই শোকে ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়ে গেল। তখন যিনি শিক্ষা বিভাগের সচিব ছিলেন তাকে বিষয়টি জানালাম। তিনি সুষ্ঠু পরীক্ষার ব্যবস্থার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন তা সবিস্তারে জানালেন এবং এ-ও জানালেন যে পরীক্ষার খাতা দেখার ব্যাপারে যাতে কোনো দুর্নীতি না হয় তার জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং মৌখিক পরীক্ষার নম্বর দশে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। যে ঘটনার কথা বলা হলো এর আগেই এই কাণ্ড ঘটেছে।

আমি নিজেও গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। সেটি ছিল ভাঙা টিনের ঘর, বেঞ্চ নড়বড়ে। ব্ল্যাকবোর্ডটা আর ব্ল্যাকবোর্ড নেই, সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু শিক্ষকরা কেউ অনুপযুক্ত ছিলেন, এটা মনে পড়ে না। যদি বাংলার শিক্ষক অনুপযুক্ত হতেন তাহলে এই লেখাটিও আমি লিখতে পারতাম না। শিক্ষকরা কোনো কোচিং সেন্টার তখন খোলেননি, লেখাপড়া সবকিছু ক্লাসেই হতো। পরীক্ষার খাতা দেখার ব্যাপারেও কোনো রকম অভিযোগ করার সুযোগ ছিল না। শিক্ষকদের কারও দোকানপাট বা ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। বেতন ছিল অত্যন্ত কম। কায়ক্লেশে দুটির বেশি জামা বা পায়জামা ছিল না কারও কাছে। শীতকালে একটিই চাদর বছরের পর বছর তারা পরেছেন। হায়রে কী কষ্ট! সেই কষ্টে থাকা শিক্ষকটি সমাজে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন।

পাঁচ লাখ বা দশ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার লোকের এখন আর অভাব নেই। শোনা যায়, একজন কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি পনেরো লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এখন ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া শিক্ষকটির অর্থনীতিটি ভাবুন। চাকরির প্রথম দিন থেকেই এই পাঁচ লাখ টাকা তোলার সংগ্রামে ওই শিক্ষক লিপ্ত হন। কী কী উপায় আছে এগুলো খুঁজে বের করার ধান্ধায় ঢুকে পড়েন। একটা হাতের কাছের উপায় হলো কোচিং সেন্টারে যুক্ত হওয়া। সেটিও একটু কঠিন। সহজ পথটি হচ্ছে নিজের একটা কোচিং সেন্টার চালু করা। সেটিও যদি না হয় তাহলে গ্রামের কোনো টাকাওয়ালা লোকের হাত ধরে একটা কিন্ডারগার্টেন খুলে ফেলা। তাতেও যদি কিছু না হয় তাহলে বাজারে একটি দোকান দিয়ে দেওয়া, সেটি মুদির দোকান বা কাপড়ের দোকান হতে পারে অথবা ছোটখাটো ঠিকাদারির সন্ধান করা, এসব কিছুই শিক্ষা থেকে অনেক দূরে।

আমি জেলা শহরে ভোরে এক বাড়িতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম একটি স্কুল চলছে। ভেবেছি এই স্কুল বোধহয় কোনো একটি প্রাইমারি স্কুলের মর্নিং সেকশন। কিন্তু একটু পরেই আমার ভুল ভাঙল। এটি আসলে একটি কোচিং সেন্টার। ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাস চলছে। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কোচিং চলবে। এরপর ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে চলে যাবে। ওই মাস্টার সাহেব তিনিও স্কুলে যাবেন। যথারীতি ক্লাসগুলো ঢিলেঢালা। কারণ লেখাপড়া যা হওয়ার তা কোচিং সেন্টারেই হয়। শিক্ষকরা স্কুলে লেখাপড়ার ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। এর মধ্যে তাদের আবার ব্যবসা-বাণিজ্য, নানা সালিশ, দেখাসাক্ষাৎ এসব রয়েছে। সরকার সম্ভবত এসব বুঝতে পেরে ভেবেছে তাদের শিক্ষার বাইরেও নানা কাজে যুক্ত করা উচিত। সে জন্য তাদের নানারকম কাজ দেওয়া হয়েছে। এই কাজগুলো দেওয়াতে সুবিধা হয়েছে যে ক্লাসে না গিয়ে ওই কাজের ছুতোয় সব সময়ই বাইরে বাইরে ঘোরাঘুরি, ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার সময়ই তার নৈতিক মেরুদণ্ডটি ভেঙে গেছে। তাই যে কোনো অসৎ উপায়ই অবলম্বন করা তার জন্য কোনো ব্যাপার নয়। অথচ প্রতিবাদ করার বিষয়টি আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকেই জেনেছি। এমনকি স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেব শিক্ষকদের যদি ভর্ৎসনা করত তাহলে ওই বয়সেই আমরা ক্ষুব্ধ হতাম। কারণ শিক্ষক অভ্রান্ত।


এখন তো অনেক শিক্ষক ছাত্রদের আশ্রয়ে থাকেন। ছাত্রদের সঙ্গে রাজনীতি করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান। একবার টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে এক স্কুলের ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করে। অনেকক্ষণ পর বাধ্য হয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম এবং বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য চাইলাম। ছাত্ররা বেঁকে বসল। আমি হেডমাস্টার সাহেবের কথা বলাতে আরও বেঁকে বসল। এবং বলেই বসল আমরা কাউকে মানি না। একজন ছাত্র আমাকে চুপি চুপি বলল, একজন শিক্ষক আছেন। তিনি যদি আসেন তাহলে ফয়সালা হবে। আমি ওই ছেলেটির সঙ্গে সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে গেলাম তিনি এলেন এবং তার সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক নেতা, আক্রান্ত ছাত্র এবং শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা হলো। ওই দারিদ্র্যক্লিষ্ট শিক্ষকটিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররাই কেন মানল? বেশিক্ষণ চিন্তা করতে হলো না, জবাব বেরিয়ে এলো তিনি যুক্তিবাদী এবং উঁচু নৈতিকতার অধিকারী। আবার কোথাও দেখেছি এ ধরনের মানুষকে শিক্ষকরাই উপহাস করেন এবং তাকে করুণার পাত্র বানিয়ে ফেলেন। কিন্তু ওই দারিদ্র্যক্লিষ্ট শিক্ষককে তা করতে পারেননি। প্রাথমিক শিক্ষা মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে যদি শিক্ষার সংস্কৃতির মধ্যে কেউ ঢুকতে না পারে তাহলে বাকি জীবন তার ফাঁকির মধ্যেই চলতে থাকবে।

কালক্রমে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। সেই পঞ্চাশ-ষাট দশকের মতো অবাস্তব বেতন কাঠামো নয়, এমনকি এই কাঠামো বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত জারি ছিল। এখন যে বেতন দেওয়া হয় তাতে মোটামুটিভাবে সচ্ছল অবস্থায় একজন গ্রামে থাকা শিক্ষক জীবন নির্বাহ করতে পারেন। যদিও শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও অনেক অর্থ লগ্নি করা প্রয়োজন। শিক্ষাই একমাত্র একটি নৈতিক এবং সুশীল সমাজের নিশ্চয়তা করতে পারে।

প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে জাপান প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুথিগত শিক্ষা ছাড়াও সুকুমার শিল্প, ক্রীড়া এবং নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা সেখানে আছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও শিক্ষাকে শুধু নম্বরভিত্তিক না রেখে ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যাতে একটি ছাত্র পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশে বহু মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়টি যুক্ত করা হচ্ছে না। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে কোথাও চাকরিবাকরিতে তারা সুযোগ পাচ্ছে না। নামে-বেনামে অনেক অস্তিত্বহীন মাদ্রাসারও খোঁজ পাওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় এমনও সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে যে, অস্তিত্বহীন মাদ্রাসায় বছরের পর বছর শিক্ষকরা বেতন তুলেছেন। ওই নামে কোনো শিক্ষকও পাওয়া যায়নি। মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নৈতিকস্খলনের বিষয়টিও জানা যায়। শিক্ষকদের পাশাপাশি তাদের নিয়োগকর্তা এবং শিক্ষা প্রশাসনের দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে দুর্নীতির বিশাল বিশাল পাহাড় নয়, পর্বত রয়েছে। এই পর্বতগুলোকে স্বচ্ছতার মধ্যে নিয়ে আসা এখন মনে হয় যে কোনো সরকারের পক্ষেই অসম্ভব।

শিক্ষা বিভাগ অথবা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি প্রাচীন আমলাতান্ত্রিক নিয়মের বাইরে করার কোনো উদ্যোগ নিলে সেটিও যে কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। যে বিষয়গুলো ওপরে আলোচনা করা হলো আমার বিশ্বাস, এসবই কারও অজানা নয়। সবাই স্বীকার করেন শিক্ষাক্ষেত্রে একটি ধস নেমেছে। এই ধস ঠেকানো না গেলে রাষ্ট্র আরও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে। দেখা যাক, বত্রিশ হাজার শিক্ষক নিয়োগে কত কোটি টাকার বাণিজ্য হবে; নাকি একজন শিক্ষকও এই বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করবেন না। আমরা সেই আশায়ই থাকলাম।

লেখক : মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

সূত্র সমকাল 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026619434356689