শিক্ষক হিসাবে অবসর নিলেও কাজ থেকে অবসর নেননি তারেক শামসুর রেহমান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত তিনজনের নামের সঙ্গে রেহমান যুক্ত আছে। রেহমান সোবহান, শফিক রেহমান ও অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান। তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না বলেই জানি। কিন্তু রেহমান সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তা আছে কি না। 

আমাকে জিজ্ঞাসা করার মূল কারণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে আমি অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের শ্রেণিকক্ষের ছাত্র ছিলাম। আমি শিক্ষক হিসাবে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে আসার বহু আগেই তিনি বিভাগ পালটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগদান করেন। সোমাবার (১৯ এপ্রিল) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান গত ১৭ এপ্রিল নিভৃতে মারা যান। এ লেখাটির মূল উদ্দেশ্য স্মৃতিচারণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। দুটি ধারায় এ লেখাটি এগিয়ে যেতে পারে। এক. শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হিসাবে অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের সাফল্য ও দুই. আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার অবদান।

এক.

আমি যখন ১৯৯১-১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ভর্তি হই, তখন সমন্বিত কোর্স হিসাবে রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, লোকপ্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো ফুল কোর্স হিসাবে পড়তে হতো। বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষকরা সরকার ও রাজনীতি বিভাগে আমাদের পড়াতেন। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের মতো অনেক মেধাবী শিক্ষক সমন্বিত কোর্স অর্থাৎ অনেক বিষয় পড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হতেন।

ড্রইংরুমে বসে সাধারণ রাজনৈতিক আলোচনা করা আর শ্রেণিকক্ষে রাজনীতি বিষয়ে পাঠদানের মধ্যে বড় একটি পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি ক্যাজুয়েল শ্রোতা ও একনিষ্ঠ শিক্ষার্থীর মধ্যে। ড্রইংরুমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে তার বক্তব্যের জন্য বিশেষ কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না। ক্যাজুয়েল শ্রোতাও এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। অন্যদিকে শ্রেণিকক্ষে যদি একজনও একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী থেকে থাকে, তাহলে শিক্ষককে পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হয়। 

তরুণ শিক্ষার্থী চিতাবাঘের জ্বলজ্বলে চোখ দিয়ে শিক্ষকের প্রতিটি বক্তব্য ও পদ্ধতি নিরীক্ষণ করে থাকে। তারপর নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে গেঁথে রাখে। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান এ বিষয়টি জানতেন বলে শ্রেণিকক্ষে বিশেষজ্ঞের মতো কথা বলতেন। শিক্ষক সত্তার সঙ্গে একজন দক্ষ কূটনীতিকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হতেন।

আমি আরও তিরিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের কথা বলছি। দীর্ঘদেহী অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান যুবক ও মধ্যবয়সির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। আশির দশকের টাইটফিট টি-শার্ট নব্বই দশকে ছাড়তে পারেননি। শ্রেণিকক্ষের বাইরে স্যার ভিন্ন একজন মানুষ। একটু চটপটে স্বভাবের এবং দ্রুত হাঁটতেন। স্যারের মধ্যে সব সময় একটা অস্থিরতা দেখতে পেতাম। মাঝেমধ্যে কোনো মতামতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হতেন না।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান শিক্ষক বাসে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগরে এসে ক্লাস নিতেন। আবার দিন থাকতেই ঢাকায় ফিরে যেতেন। কখনোই দেরিতে ক্লাস শুরু করতেন না।

শ্রেণিকক্ষে লেকচারের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্ত আলোচনা ও বিতর্ককে উসকে দিতেন। এতে শিক্ষার্থীরা আরও সপ্রতিভ ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠত। নিজ অফিস রুমে ডেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়গুলো আমার খুবই ভালো লাগত।

একবার আমার মনে আছে, পরীক্ষা হলে কয়েকজন ভালো শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের কাছে শুধু বর্ণনা আশা করি না, তোমরা চমৎকার বিশ্লেষণ দেবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।

দুই.

একজন শিক্ষক যদি গবেষণা না করেন তাহলে শ্রেণিকক্ষে তিনি প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েন। শুধু বই পড়ে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে বইয়ের অনুবাদ করতে থাকেন। শক্ত শক্ত বইয়ের নরম নরম অনুবাদ। তাই শিক্ষকের মৌলিক চিন্তা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান এ বিষয়ে একদম ভিন্ন একজন শিক্ষক। চার দশক ধরে তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর তার ফল পেয়েছে শ্রেণিকক্ষে তার শিক্ষার্থীরা।

অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান ছিলেন এক ভিন্ন ধরনের শিক্ষক। তিনি অনেক একাডেমিক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার চিন্তাকে সব সময়ই যুক্ত রেখেছেন। এ প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে পাবলিক নলেজ বা গণজ্ঞান। পণ্ডিতের জ্ঞান গণমানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। জ্ঞানকে ব্যবহারিক করা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সব্যসাচী লেখক ছিলেন অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান। দেশে-বিদেশে বই প্রকাশের পাশাপাশি তিনি পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। বাংলাদেশে এমন কোনো প্রথম শ্রেণির পত্রিকা নেই যে, তাতে তিনি লিখেননি। টেলিভিশনে নিয়মিত এসে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বক্তব্য রাখতেন। তাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গণবয়ানে তার অবদান থাকত।

একজন মানুষের জীবনে ইংরেজি ভাষার তিনটি অদ্যাক্ষরের সমন্বয় থাকলে অসাধারণ কিছু ঘটতে পারে। প্যাশন, প্রফেশন ও প্লেস। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান এ তিনটি শব্দের মিলন ঘটাতে পেরেছিলেন। তার প্যাশন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, তিনি প্রফেশন হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে শিক্ষকতা এবং সর্বশেষে তিনি কর্মক্ষেত্র হিসাবে বাংলাদেশকে প্লেস নির্ধারণ করেছিলেন। অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান শিক্ষক হিসাবে অবসর নিয়েছিলেন কিন্তু কাজ থেকে কখনোই অবসর নেননি। বাংলাদেশের জন্য তিনি আরও কিছুদিন অপরিহার্য ছিলেন।

লেখক : ড. শাকিল আহম্মেদ, সহকারী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024402141571045