বরিশাল নগরীর হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার মামলা করেন তার নানা। গত ৯ মে দুপুর ১টার দিকে বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে জানিয়ে প্রায় ছয় মাস পর মামলাটি হয়। ওইদিন বিদ্যালয় খোলা ছিলো। তবে প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ছাত্রী, ৪২ জন শিক্ষক ও ৯ জন কর্মচারীর কেউ ঘটনাটি দেখেননি। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায়ও ধরা পড়েনি ধর্ষণচেষ্টার কিছু। আবার অভিযুক্ত শিক্ষককে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে দুদিন আগে বহিষ্কার করায় তারও বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা নয়। তবে রহস্যঘেরা এমন ঘটনায় মামলার পর উঠেছে উল্টো অভিযোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষকদেরই একটি চক্র ছাত্রীদের দিয়ে এসব মামলা করায়। প্রতিষ্ঠানে বছরে কয়েক কোটি টাকা আয়ের নিয়ন্ত্রণ এবং কোচিং বাণিজ্য নিয়ে বিরোধে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ছাত্রীদের ব্যবহার করা হয়। এর আগে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে ছাত্রীর মামলা আদালতে মিথ্যাও প্রমাণিত হয়। এর হোতা প্রধান শিক্ষক এসএম ফখরুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে গেলেই শিক্ষককে ফাঁসাতে ছাত্রীদের ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ। এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটি গত ১০ বছরে স্কুলটির সব আয়-ব্যয়ের প্রমাণপত্রও চেয়েছে তার কাছে।
সর্বশেষ ধর্ষণচেষ্টা মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইয়ে দেয়ার কথা বলে বাদীর নাতিসহ কয়েক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেন শিক্ষক মাইদুল ইসলাম। ছাত্রীরা ৬ মে প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় পরদিনই পরিচালনা পর্ষদের সভায় মাইদুল ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ৯ মে তার নাতিকে শ্রেণিকক্ষে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। চিৎকার শুনে বাদী, তার স্ত্রী ও বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা সাব্বির আলী শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ছাত্রীকে উদ্ধার করেন। পালিয়ে যান মাইদুল ইসলাম।
মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে বাদীর স্ত্রী, পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ফয়সুল আলম ফিরোজ ও স্থানীয় চারজনকে। বিদ্যালয়ের ঘটনায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মচারীদের সাক্ষী করা হয়নি কেনো–জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বাদী বলেন, ‘পুলিশ সব তদন্ত করে দেখবে।’ ঘটনার ছয় মাস পর মামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন সময় হয়েছে, তাই করেছি।’ মামলার তিন নম্বর সাক্ষী সাব্বির বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। লোকমুখে শুনেছেন, এমন মামলায় তাকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, তিনি আট বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। শিক্ষকদের কোচিংয়ের ৪০ ভাগ টাকা বিদ্যালয়ে দিতে হয়। গত মে মাসে তৎকালীন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক সেটি ৫০ ভাগে উন্নীত করেন। তিনি এতে রাজি না হওয়ায় ৬ মে ষষ্ঠ শ্রেণির ১৩ ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ডেকে যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগে সই করানো হয়। ওই দিনই তদন্ত কমিটি গঠন এবং পরদিন সভা ডেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। মাইদুল ইসলাম আরো বলেন, চাকরি ফিরে পেতে তিনি আদালতে মামলা করেছেন। এ ছাড়া মানহানির মামলাও করেছেন। দুটি মামলাতেই প্রধান শিক্ষক ধরাশায়ী হবেন। এ কারণে এক ছাত্রীর নানাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করিয়েছেন।
এর আগে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়ে ইংরেজির খণ্ডকালীন শিক্ষক এনামুল হক নাসিমের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। এতে ১৬ দিন কারাভোগও করেন নাসিম। পরে মিথ্যা প্রমাণ হওয়ায় আদালতের নির্দেশে নাসিম মামলা থেকে অব্যাহতির পাশাপাশি চাকরি ফিরে পান।
ওই রায়ে বলা হয়, পুলিশের উপস্থিতিতে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ছয় ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে নাসিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছিলো। তারা রাজি না হলে পরে একটি কাগজে সই নেয়া হয়। এর পর মামলা হলেও ওই ছাত্রীরা কিছুই জানতো না।
নেপথ্যে অর্থ লোপাট ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব
বরিশালে সুপ্রতিষ্ঠিত কয়েকটি বিদ্যালয়ের একটি গোড়াচাঁদ দাস রোডের হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে তিন হাজার ছাত্রী পড়লেও স্থায়ী শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৪ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষক ২৮ জন। অভিযোগ, এই শিক্ষকদের দিয়ে কোচিং বাণিজ্য করানো হয়। কোচিংয়ে শিক্ষার্থী বাগানো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে বিরোধ।
এ ছাড়া নানা অজুহাতে খণ্ডকালীন শিক্ষককে বরখাস্ত করে নতুন নিয়োগ বাণিজ্য হয়। অবসরে যাওয়া শিক্ষক একেএম জামাল, মাসুদা বেগম ও শেখ জেবুন্নেছাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধান শিক্ষক। জানা যায়, বিদ্যালয়ের বার্ষিক আয় অনেক। তিন হাজার ছাত্রীর গড় বেতন ৫০০ করে হলে শুধু এ খাতেই আসে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া কোচিংয়ের অর্ধেক টাকা পাওয়ায় সেখান থেকেও ভালো আয় হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে ম্যানেজ করে ভুয়া ভাউচারে এসব টাকা লোপাট হয়। এসবের প্রতিবাদ করলেই সেই শিক্ষকদের ফাঁসানো হয়।
বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. মহিউদ্দিন বলেন, অর্থ লোপাট, ছাত্রীদের ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অনিয়মে জড়িত প্রধান শিক্ষক। তিনি এর প্রতিবাদ করায় হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। সর্বশেষ ধর্ষণচেষ্টা মামলা প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক এসএম ফখরুজ্জামান বলেন, মামলার পরই ঘটনাটি জেনেছেন। বিদ্যালয়ের বাইরের লোকজনকে সাক্ষী করার বিষয়ে বলেন, এটা বাদীর ব্যক্তিগত বিষয়। কয়েকজন অভিভাবক সাক্ষী হয়েছেন বলে শুনেছেন।
তার দাবি, বরখাস্ত হয়ে শিক্ষক মাইদুল ইসলাম মিথ্যা অভিযোগ করছেন।