শিক্ষককে লাথি, হতবাক বিশ্ব!

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

বাংলাদেশের সচেতন জনগণের পাশাপাশি বিশ্ব আজ প্রাথমিক শিক্ষকের প্রতি চরম অবমাননার দৃশ্য বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের শিক্ষক নেতারা এ বিষয়ে তাদের উদ্যোগ ও ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার দুর্নীতির সহায়তা না করায় একজন শিক্ষককে চরম শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পাশাপাশি পেয়েছেন সাময়িক বরখাস্তের আদেশ। আত্মপক্ষ সমর্থন ব্যতিরেকে এ শাস্তি কতটা বিধিসম্মত বোধগম্য নয়। অনেকটা ‘চুরি চুরি সিনা জুরি’  প্রবাদের মতো।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার্স সমিতির ফেসবুকের মতামত থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের নির্দেশে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্র রায় বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যান। তিনি পরিদর্শনকালে শিক্ষককে লাথি, কিল ও ঘুষি মারেন। ওই দিন শিক্ষকের স্ত্রীর এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। স্বাভাবিকভাবে স্ত্রীর এই সময়টায় শিক্ষকের হাসপাতালে ব্যস্ত থাকার কথা। তার এমন একটি সময়ে বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে এহেন ঘটনা ঘটানো মনুষ্যত্বহীন বিবেকবর্জিত পাষণ্ডের পক্ষেই সম্ভব। আগের কর্মস্থলে গোপালগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অসংখ্য দুর্নীতির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

লাথি, কিল-ঘুষির সমর্থনে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার পক্ষে সাফাই গাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিক্ষা অফিসার্স সমিতির সভাপতি মোফাজ্জল হোসেনকে বলব- সরজমিন এসে বাস্তব ঘটনা দেখে মতামত দিন। কর্মস্থলে অবস্থান করে না দেখে সত্যি ঘটনা না জেনে ফেসবুকে মতামত দেওয়া কতটা যৌক্তিক? প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের একজন কর্মকর্তা হিসাবে পরিবারের সব সদস্যের প্রতি সমান আচরণের প্রত্যাশা রইল। দুর্নীতিবাজ কাউকে না জেনে সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা করলে তার পাপের আগুন ছড়িয়ে কাউকে রক্ষা করবেন না।

প্রাথমিক শিক্ষকসহ সব কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।  প্রতিমন্ত্রীসহ সবাই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন তথা শিক্ষার্থীর সেবায় নিয়োজিত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে মহাক্ষমতা দেখানোর সুযোগ নেই।  কিছু দিন আগে ‘প্রাথমিক শিক্ষকেরাও মানুষ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে প্রাথমিক শিক্ষার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা প্রসঙ্গে একটি ছোট গল্পের অবতারণা করেছিলাম। গল্পটা হলো- সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে অফিসে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন। পর পর আজরাইল শিক্ষকের জান কবচ করতে আসলেন। উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এতই জঘন্য প্রকৃতির যে, শিক্ষক আজরাইলের চেয়ে ওই কর্মকর্তাকে বেশি ভয় করতেন। শিক্ষক মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে আজরাইলের কাছে একটু সময় নিয়ে কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলেন।

উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসারের পদটি প্রাথমিক শিক্ষকদের ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের আন্দোলনের ফসল। সামরিক সরকারের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা পৌরসভা ও গ্রাম সরকারের কাছে ন্যস্ত করার ২টি আইন জাতীয় সংসদে পাস করেছিলেন। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষকরা ২মাস ৬দিন বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার আইন ২টি বাতিল করতে বাধ্য হয়। আজ আবার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে প্রাথমিক শিক্ষক লাঞ্ছিত। প্রাথমিক শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ ৮১-এর কণ্ঠস্বর আজ আরেকবার বেজে উঠুক, এ  লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে। প্রাথমিক শিক্ষকসহ কর্মকর্তা অন্যায় করলে বিধি মোতাবেক শাস্তি পাবেন এটি হওয়া কাম্য। কোনো অবস্থাতে মারধরের প্রশ্নই আসে না। লাথি ও মারধর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নগন্য সংখ্যক দুর্নীতিবাজরা ঐক্যবদ্ধ।

প্রাথমিক শিক্ষকেরা শিক্ষিত নাগরিকদের প্রথম শিক্ষক। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাধারণত বিদ্যালয় দেখভাল করে অনিয়ম ও সমস্যা নিরসনে  উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে থাকেন। শিক্ষকতা মহান পেশা। পেশাটি শ্রদ্ধা ও ভালবাসাপূর্ণ। অন্য কোনো পেশায় এত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নেই। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ছিল শিশুদের শিক্ষক হওয়ার। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে পুরো জাতির শিক্ষক তথা দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র প্রাথমিকের শিক্ষকেরা। প্রাথমিক শিক্ষায় অসংখ্য সৎ নীতিবান কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং কমিটি রয়েছে।

গুটি কয়েক অসৎ কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং কমিটি স্লিপের টাকাসহ উন্নয়নের নানাবিধ অর্থের বখরা দাবি করে প্রাথমিক শিক্ষায়  প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতির ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির নাম পরিবর্তন করে বিদ্যালয় কল্যাণ সমিতি নামকরণের সুপারিশ করছি। ওই কমিটির প্রধান থাকবেন প্রধান শিক্ষক, সব সহকারী শিক্ষক সদস্য, শ্রেণিভিত্তিক মেধাবী শিক্ষার্থীর অভিভাবক থাকবেন সদস্য, জমিদাতা বা উত্তরাধিকারী থাকবেন সদস্য। সকল সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন সদস্য সচিব। বিদ্যালয় পরিচালনা করার মানসিকতা দূর হয়ে গড়ে উঠবে বিদ্যালয়ের কল্যাণ করার উদ্যোগ। প্রধান শিক্ষককে লাথি মারার ঘটনা অস্বীকার করার মানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করার প্রমাণপত্র সবই কি অসত্য? বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সংবাদ কি ভিত্তিহীন? তাহলে কি প্রধান শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাসকে গোপালগঞ্জের ভূত-পেত্নি লাথি ও মারধর করেছেন ?

প্রাথমিকের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সদস্য তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব  ও পরিচালনায় গড়ে উঠবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্বকে দূরে ঠেলে দিয়ে গোপালগঞ্জের অসৎ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির উন্নয়নের টাকার ভাগবাটোয়ারার বিষয়টি সাংবাদিক, সূধিমহলসহ সাধারণ জনগণের মুখে মুখে। আজ প্রধান শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাসের মত উন্নয়নের টাকা বিদ্যালয়ের কাজে ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কারো না দেওয়ার মানসিকতা সকল শিক্ষকের মাঝে গড়ে উঠুক। গুটি কয়েক দুর্নীতিবাজের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ প্রাথমিক শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলা থেকে দুর্নীতিবাজদের উৎখাত করে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতিবাজ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা পরিবারের সকল কর্মকর্তা এ ঘটনায় ব্যথিত। তাঁরা প্রাথমিক শিক্ষকের এ বর্বরতম ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছে। খুব দ্রুত দুর্নীতিবাজদের খোলস বেরিয়ে আসবে। দুর্নীতি ও বর্বরতার বিরুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ আগামী ২৮ অক্টোবর দুপুর ২টায় প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। সকল শিক্ষক সংগঠন মতাদর্শের বাইরে এসে প্রতিবাদ করবেন। এ প্রত্যাশা রইল।

নবভূমিষ্ঠ শিশুকে নিয়ে মনোজ কান্তি বিশ্বাসের স্ত্রী এখন স্বামীর সেবায় হাসপাতালে। সনাতন ধর্মের বৃহৎ উৎসব দুর্গাপূজা উৎসবের ছোঁয়া মনোজ কান্তি বিশ্বাসের পরিবারে মাঝে আসতে পারেনি। ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আজ মনোজ শিক্ষকতার পবিত্র আদর্শ নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। তাঁকে ২ বার দেখতে গিয়ে তাঁর ওপর বর্বরতম দৃশ্য দেখে ও শুনে ব্যথিত মনে চোখের জল বেরিয়ে এলো। মনোজ তুমি আদর্শ হয়ে বেঁচে থাকো, এ দেশের নাগরিক ও প্রাথমিক শিক্ষকের মাঝে। মনোজের প্রতিবাদের কণ্ঠের সঙ্গে এক হয়ে সব শিক্ষকের মাঝে প্রতিবাদের ঝড় উঠুক।

লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015069007873535