অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমানের (১৯২৮-১৯৯৬) সঙ্গে আমার পরিচয় যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। নোমানের পিতা এক সময় আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার পিতার বন্ধু। তারা এক সময় একই আদালতে ওকালতি করতেন। কিন্তু ছোটবেলায় তাকে দেখেছি বলে মনে হয় না। আমার যখন জন্ম, তখন তিনি কলেজে পড়ছেন। আমি যখন ঢাকা কলেজে পড়ি, তখন তার ছাত্র হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রথিতযশা একজন শিক্ষক হিসেবে তার নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু তার ছাত্র হওয়া সম্ভব হলো না। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে বদলি হয়ে যান। আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে গেলে তিনি আবার ঢাকা কলেজে আসেন। তার পৈতৃক আবাস বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। আমাদের বাড়ি নবীনগর। সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ঐতিহাসিকভাবে নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর উপজেলা অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তবুও 'যাকে আমরা বলি দেশের বাড়ি' সেখানে আমাদের পরিচয় হয়নি। আমার সঙ্গে তার পরিচয় বাংলাদেশ সচিবালয়ে। ১৯৭২ সালে আমি যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, তখন তিনি গণশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক। কিংবদন্তিতুল্য এ শিক্ষকের সঙ্গে আমার পরিচয় আমলারূপে। আমরা দু'জনই তখন নির্ভেজাল আমলা। তবে আমলা হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকের সব গুণই তার ছিল। অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, কনিষ্ঠদের প্রতি স্নেহশীল। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধা আদায় করে নেন। কিন্তু শিক্ষকের মেজাজ সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন সফল প্রশাসক। কলেজ প্রশাসনের কাজটি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। একজন দক্ষ আমলার মতো আইন-কানুনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। কোনো রক্তচক্ষু বা প্রলোভন তাকে নীতির পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মন্ত্রণালয়ের ছোট-বড় সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। তার বন্ধুরা বলতেন, পাকিস্তানি হানাদাররা ১৯৭১ সালে তার বাসা আক্রমণ করে ও তাকে মারার জন্য বন্দুক তাক করে। কিন্তু তার মুখে সারল্য, পবিত্রতা ও নিস্কলুষতা এত স্পষ্ট ছিল যে, জালিমের হাত কেঁপে যায়। এরা বন্দুক নামিয়ে নেয় এবং আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, তিনি বেঁচে যান।
শিক্ষকতা তার অগত্যার গতি ছিল না। তিনি স্বেচ্ছায় শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন। ১৯৫১ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তার পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সরকারি কলেজে যোগ দেন। বিশ শতকের চল্লিশের ও পঞ্চাশের দশকে অনেক মেধাবী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে সরকারি কলেজে চলে যেতেন। তার কারণ ছিল দুটো- তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের প্রারম্ভিক বেতন ছিল ১২৫ টাকা; সরকারি কলেজে ছিল ১৫০ টাকা। তখন ২৫ টাকা একটি বড় অঙ্ক ছিল। তার চেয়েও বড় কারণ, সরকারি চাকরিতে পেনশন ছিল কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ছিল না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররাই নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্ররাও সরকারি কলেজে চাকরি পছন্দ করত। সরকারি কলেজের মধ্যে তিনি ঢাকা কলেজেই বেশিদিন কাজ করেছেন। তবু বদলি চাকরির সুবাদে তিনি চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট এমসি কলেজে পড়িয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তার সাফল্য ছিল অসাধারণ। ইংরেজি একটি আবশ্যিক বিষয় হওয়াতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি দেশের সব বিষয় এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রদের পড়ানোর সুযোগ পান। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার ছাত্ররা এখনও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এ মূল্যায়ন কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার, অধ্যাপক নোমান ১৯৭০ সালে পুরো পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রেসিডেন্টের পদক পান। শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
শিক্ষকতার কাজ করতে করতে তিনি শিক্ষা প্রশাসনে জড়িয়ে পড়েন। পাঁচ বছর ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সাত বছর ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ; কিছু সময় জাহাঙ্গীরনগরে উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজের অধ্যক্ষও ছিলেন। একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন বলেই এসব গুরুদায়িত্ব তিনি অতি সহজে পালন করতে পেরেছেন। বাইরে সফল কর্মী মনে হলেও তিনি আসলে ছিলেন আদর্শবাদী। সাহিত্যের এই অধ্যাপক ছিলেন রোমান্টিক কবিদের মতো সত্য, সুন্দর ও পরিপূর্ণতার পূজারি। জীবনের কোনো ভোগ-লালসাই তাকে ন্যায় ও সুন্দরের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাই তার বন্ধু কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ''যখন তারুণ্য ছিল দেহ মনে কীটস-এর ওড/আপনাকে বড় বেশি করেছে উন্মন/মৎস্যকন্যা ডেকে নিয়ে গেছে নীল সমুদ্রের দিকে; এই দর কষাকষি, ত্রূক্রর ঘষাঘষিময় জগত সংসারে/ছিলেন নিছক বেমানান, বুঝি তাই/ফেসাদ, বচসা, খেয়োখেয়ি/থেকে রেখেছেন/নিজেকে আড়ালে আর একদিন বড়ই নিঃসঙ্গ/হঠাৎ গেছেন বিশে অন্তহীন ঘন কুয়াশায়।"
লেখক : আকবর আলি খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা