শিক্ষকদের আত্তীকরণ: শিয়ালের পাঠশালায় কচ্ছপের বাচ্চার উচ্চশিক্ষা

এস এম মাসউদ মোস্তফা |

'গ্যারাকল 'শব্দটি বৃহত্তর ময়মনসিংহে বহুল প্রচলিত একটি লোকজ শব্দ। এর সঠিক অর্থ আমাদের জানা নেই । তবে যতদূর বুঝেছি --- কোন কর্মকাণ্ড আটকে থাকা বা ঝুলে থাকা । যাকে বলা হয় স্থিতাবস্থা ।                                                     

বলছিলাম, কলেজ সরকারিকরণ প্রসঙ্গে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, গ্রাম শহর সমতা বিধান তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ সর্বোপরি শিক্ষায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষে প্রতি উপজেলায় ১টি স্কুল ও ১টি কলেজ সরকারি করার সিদ্ধান্ত নেন। এই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রথমে ২৭১টি পরবর্তীতে আরও ৩৩ টি মোট ৩০৪ টি কলেজ সরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সব সময়ই উপজেলা বা জেলার সেরা কলেজগুলো সরকারি বা জাতীয়করণ হয়। 

প্রধানমন্ত্রী এ যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তারপর চলে যায় দুটি বছর। অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। অবশেষে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট কলেজগুলো সরকারি করে প্রজ্ঞাপন জারি হয় । শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় । 

কিন্তু হিংসুটে বাঙালির হিংসার ছোবল বড়ই নির্মম । আরও দুটি বছর অতিক্রান্ত হতে চললো। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ প্রায় শেষ। আজও ৩০৪ কলেজের সাইনবোর্ড পরিবর্তন ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি।  এদিকে সরকারিকরণের জন্য নির্বাচিত কলেজগুলোর ১৫ হাজার শিক্ষক কর্মচারী মধ্য থেকে ইতোমধ্যে দুই হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মচারী কোন ধরণের সরকারি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই অশ্রুসিক্ত হয়ে কর্মস্থল থেকে বিদায় নিয়েছেন। সরকারিকরণ প্রক্রিয়ার যে কচ্ছপ গতি, ততে মনে হয় একদিন সরকারি হয়তো হবে কিন্তু সে দিন আর কোন শিক্ষক কর্মচারীকে আত্তীকরণ প্রয়োজন হবে না। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তেক্ষেপ ছাড়া আর কোন বিকল্প আমাদের জানা নেই।   

২০১৬ থেকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ এই ৫ বছরে উপজেলা পর্যায়ের সেরা কলেজগুলো তাদের অতীত ঐতিহ্য আর ধরে রাখতে পারছে না । সরকারি বিধিনিষেধের কারণে কলেজগুলো নানাবিধ সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত।  শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। শিক্ষক কর্মচারীদের আভ্যন্তরিন উৎস থেকে প্রাপ্ত বেতন ভাতাদি বন্ধ রয়েছে। ননএমপিও শিক্ষক কর্মচারীরা বেতন ভাতা না পেয়ে মনবেতর জীবন যাপন করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে উপজেলা পর্যায়ের ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো যা এতদিন পার্শ্ববর্তী সরকারি কলেজগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলতো সে ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হবে ।

কিন্ত কেন এই বিড়ম্বনা! বলতে গেলে আমাদের দূর্ভাগ্য, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির একদল উচ্ছৃঙ্খল নবীন শিক্ষক, শুরু থেকেই এই মহতী উদ্যোগের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু কেন? নিজের অধিকার লাভের জন্য আন্দোলন করা যায় কিন্তু অন্যের অধিকার হরণের জন্য আন্দোলন!! এ কেমন মানসিকতা?  

রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।’
                                                               
শিক্ষক হয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান! এ যেন, ‘কাকের মাংস কাকে খাওয়া’। আমরা বিস্মিত, স্তম্ভিত এবং গভীর উদ্বিগ্ন। এসব তথা কথিত শিক্ষক সমাজ, সরকারিকরণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে হেন কোন অপকর্ম নেই যা করেন নি। মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, সংবাদ সন্মেলন, পরীক্ষা বর্জন এমন কি চাঁদাবাজির মতো ঘৃণ্য অপকর্মও তারা বাদ রাখেননি। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের বিরুদ্ধে যারা আদালতে গিয়েছিলেন সেই দুই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাই এখন শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত। তারাই ছলেবলে কৌশলে আটকে রেখেছে পদসৃজন ও আত্তীকরণ। 

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রাণপুরুষ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্বার্থক উচ্চারণ ‘মেদিনী বিদার হও পশিয়া লুকাই’। অর্থাৎ ধরিত্রী তুমি দ্বি-খণ্ডিত হও, আমি তোমাতে আত্মগোপন করি।  শিক্ষা সচিব ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি মহোদয় গত সেপ্টেম্বর মাসে সদ্য জাতীয়কৃত শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আত্তীকরণসহ কলেজ সরকারিকরণের সব কাজ শেষ করবেন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে অক্টোবর থেকে দৃশ্যত কোন কাজই হয়নি। সত্যকথা বলতে গেলে কঠিন গ্যারাকলে আটকে আছে কলেজ সরকারিকরণ।

বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, যে মহলটি (সরকার বিরোধী ) শুরু থেকেই সরকারের অর্জন ম্লান করে দেয়ার মানসে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কলেজ সরকারিকরণের বিরোধিতা করে আসছিলো, দূর্ভাগ্যবশত তাদেরকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে কলেজ সরকারিকরণের কাজে। 

এ যেন ‘শিয়ালের পাঠশালায় কচ্ছপের বাচ্চার উচ্চশিক্ষা’। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের (দায়িত্বপ্রাপ্ত) এসব শিক্ষক কর্মকর্তারা নানান ফন্দিফিকির করে বছরের পর বছর কলেজ সরকারিকরণের কার্যক্রম আটকে রেখেছেন। তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচিত কলেজগুলো প্রচুর সমস্যা রয়েছে যা সমাধান করা অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই বলতে ইচ্ছে করে, ‘দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর।’

লেখক : এস এম মাসউদ মোস্তফা, শিক্ষক, বারহাট্টা সরকারি কলেজ , নেত্রকোনা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027968883514404