জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) নবনির্মিত ছয়টি হল ও ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুইজন শিক্ষককে তাদের আসন থেকে তুলে দিয়ে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বসানোর ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে এ ঘটনা ঘটে।
সকাল ১০টার দিকে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৪১টি স্থাপনার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি স্থাপনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, হল প্রাধ্যক্ষগণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, অনুষ্ঠান শুরুর ২৪ মিনিট পর প্রায় ২০ জন নেতাকর্মীসহ অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হন জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন। ততক্ষণে অডিটোরিয়াম ভবন অতিথিতে পরিপূর্ণ। জায়গা না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন লিটন ও তার অনুসারীরা। তাদের শান্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান উপস্থিত হন। তখন প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রক্টর তাদের নিয়ে অডিটোরিয়ামের বাইরে চলে যান। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরে প্রক্টরের অনুরোধে স্লোগান বন্ধ করেন তারা।
অডিটোরিয়াম ভবনের সামনে গিয়ে প্রক্টরের সঙ্গে আরেক দফায় বাগবিতণ্ডায় জড়ান সাধারণ সম্পাদক ও তার অনুসারীরা। এ সময় জাবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শেখ শাহরিয়ার ইসলাম আকাশ অনুষ্ঠান চলাকালে অডিটোরিয়াম ভবনে তালা দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি বলেন, আমাদের জন্য জায়গা রাখা হয়নি, আমরা তাহলে অডিটোরিয়ামে তালা দিয়ে চলে যাই।
এর কিছুক্ষণ পর অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হন জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল। তার বসার জন্য জায়গা নেই।
পরিস্থিতি শান্ত করতে অডিটোরিয়ামের তৃতীয় সারিতে বসা প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও দর্শন বিভাগের দুই প্রভাষককে তাদের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন প্রক্টর ফিরোজ-উল-হাসান। তাদের যথাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম সারির আসনে বসানো হয়। শিক্ষকদের আসনে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে বসানো হয়। পরে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই ওই দুই শিক্ষক অডিটোরিয়াম ত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রামে ছাত্রলীগের এমন আচরণকে ‘অশোভন’ ও শিক্ষকদের জন্য ‘লজ্জাকর’ বলে মন্তব্য করেন উপস্থিত শিক্ষকরা। জীববিজ্ঞান অনুষদের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, এমন জাঁকজমকপূর্ণ প্রোগ্রামে ছাত্রলীগের এমন আচরণ খুবই অশোভন। ভরা মজলিশে দুজন সম্মানিত শিক্ষককে তুলে দিয়ে সেই জায়গায় ছাত্রলীগ নেতাদের বসানো শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক ও লজ্জার। আমি এ ঘটনার নিন্দা জানাই।
আরেক অধ্যাপক বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম সারিতে জায়গা যখন ফাঁকাই ছিল তখন ছাত্রলীগ নেতাদের সেই আসনে বসানো যেত। দুইজন শিক্ষককে তুলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাদেরকে তুলে দিয়ে শিক্ষক সমাজকে নিচু করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, আমরা ছাত্রলীগকে আগে আসতে বলেছিলাম। আগে আসলে এ ঘটনা ঘটত না। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দাবি করেছিল যে স্ক্রিনে যাতে সভাপতি-সেক্রেটারিকে দেখা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সারিতে বসতে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার ওখানে অনুরোধ করার মতো জুনিয়র ওই দুজনই (শিক্ষক) ছিল। অন্য কাউকে অনুরোধ করার কোনো সুযোগ ছিল না। ম্যাক্সিমাম সিনিয়র এবং অন্য অপরিচিত যারা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-অফিসাররা সেখানে ছিল। এই দুজন আমার অত্যন্ত কাছের এবং আপনজন দেখেই আমি তাদের অনুরোধ করতে পেরেছি। তারা হয়তো মনে কষ্ট পেলেও অনুরোধ রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের তো সবকিছু সমন্বয় করতে হয়। ওরা আগে আসলে এই সমস্যাটা হতো না। সামনের দিকেই বসতে পারত। আমি প্রত্যাশা করব যে, এর পরে কোনো প্রোগ্রামে তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে আসে এবং তারা যেখানে বসতে চায়, সেখানে বসতে পারে। পুরো প্রোগ্রামটা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থেই আমি খুব কাছের দুজন মানুষকে অনুরোধ করে ছাত্রলীগ নেতাদের জায়গা দিয়েছি।
এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এম শামীম কায়সার বলেন, আমি ঘটানটি শুনেছি। আমি এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। কোনো শিক্ষকের সঙ্গে যদি এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে আমরা শিক্ষক সমিতি এর প্রতিবাদ করব। আমি প্রক্টরের সঙ্গে কথা বলে দেখব কী ঘটেছিল সেখানে।
এ বিষয়ে জানতে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।