শিক্ষকদের পদত্যাগ ও সংস্কার

শাহ কামাল |

যিনি শেখান তিনি শিক্ষক। হোক তা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক। পিতা-মাতার পর সশ্রদ্ধ ভাষায় শিক্ষকের মর্যাদা। বোধকরি বাদশাহ আলমগীর তা বুঝতে পেরেই সন্তানকে শিক্ষকের পা ধুয়ে দিতে বলেছিলেন। তিনি মহান বাদশাহ ছিলেন বলেই এমনটা করেননি। এখানে শিক্ষা হলো এই, শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে কোনো আপস নেই। শিক্ষকের পরিচয় জাত-পাত কিংবা ধর্ম আরাধনায় নয়, তার পরিচয় তিনি শিক্ষক। যুগের পরিক্রমায়, কালের নির্মম পরিহাসে শিক্ষকের স্থানচ্যুতি হয়েছে। সে কারণে তার মর্যাদার চাদর স্থানে স্থানে ফুটো, কখনো বা সুঁইয়ের ফোঁড়ে আটকানো। যদি এর রহস্যজট খুলতে চাই তবে বেশি আগানোর প্রয়োজন কী?

একটা সময় শিক্ষকতা করতেন কারা? আরবি হরফের আগা গোড়া, কিছুটা কুরআনি দখল আর ভাবাবেগে যারা মোনাজাত করতে পারতেন তারা মসজিদের মক্তবে পড়াতেন। দূরদেশে আধুনিক শিক্ষার কিছু পুঁথি আত্মস্থ করে সমাজে যারা উঁচু শ্রেণির ছিলেন তাদের অবসর কাটানোর একটা উত্তম মাধ্যম ছিলো শিক্ষকতা। অবশ্য এ কাজে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিলো সিদ্ধহস্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতেই শিক্ষকতা একটা ব্রত। অবসর সময় কাটানোর পাশাপাশি এই যে শিক্ষা প্রদান তা পেশায় আসতে আসতে আমরা ততো দিনে ইংরেজদের কলা-কৌশলে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি। বাছ-বিচারের পর্দাটা যদি শক্তভাবে টানা হয় তবে শত কষ্টেও শিক্ষকের মর্যাদা ছিলো সবার ওপরে। তবে কালেভদ্রে তা বাণিজ্যিকরূপ পেলেও তা কিন্তু একদিনে হয়নি। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের যোগ্যতাতেও ভাটা পড়ে। ফলে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হতে থাকে।

শিক্ষায় সমস্যা নতুন কোনো বিষয় নয়। আপনি যদি প্রমথ চৌধুরীর ‘বইপড়া’ প্রবন্ধটি পড়ে থাকেন তাহলে বুঝবেন। আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় যে সমস্যার হুলুস্থুল তা ১৯৪৭ এর আগেও এদেশে ছিলো। আদর্শ শিক্ষকের কাজ জ্ঞানের মশাল প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীর পাশে থাকা; মশাল জ্বালানো নয়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়।’ তার মানে হলো ইংরেজদের সময়েও শিক্ষক সমাজ আজকের মতোই শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী করে ছবক গেলাতেন, যা কারো সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হতো না। বোধকরি সেজন্যই তিনি বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজ বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য’। এখানে আমার এসব উপমা দেয়ার কারণ হলো আজো কী আমরা শিক্ষক সমাজ প্রকৃত শিক্ষক হতে পেরেছি? তবে এটা যে কেবল শিক্ষক সমাজের দোষ তা নয়, শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিও রয়েছে। শিক্ষকেরা নিজের কর্তৃত্ব চায়। সেই কর্তৃত্বের বীজ ফলাতে গিয়ে তারা সহকর্মীকে প্রতিপক্ষ ভাবতেও সময় নেন না। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর নিকট আদর্শ হতে গিয়ে নিজেকে মৌলিকরূপে উপস্থাপন না করে মহামানবরূপে আবির্ভূত হতে চান। তখনই ঘটে বিপত্তি। একদিকে নিজের কর্তৃত্ব ফলানো অন্যদিকে পেটের হাহাকারে পকেটের চিন্তা। সেই সঙ্গে শিক্ষায় যুগে যুগে যতো পরিবর্তন তা শিক্ষার্থীর কল্যাণ না করলেও নোট-গাইড আর কোচিং ব্যবসাকে একটা স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় যতো পরিবর্তন তার ধাপে ধাপে কেবল তা বাণিজ্যেই রূপান্তরিত হয়েছে। আর সে বাণিজ্যের ভাগীদার হতে শিক্ষকেরা তাদের স্তর হতে নিচে নামতে শুরু করেছেন। উত্তরপত্রে নম্বর প্রদানে বৈষম্যের উদ্বোধনও এভাবেই। এরপর প্রাইভেট টিউশনি। একেকজন শিক্ষক তার ক্লাসে সঠিক শিক্ষার নির্দেশনা দিতে পারলে তার আর আলাদা পড়ার প্রয়োজন পড়তো না। এক্ষেত্রে অংশীজনের অভিযোগ থাকবে এটাই যে অধিক শিক্ষার্থীর জন্য তিনি ক্লাসে সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। তবে একটা কথা তো আমরা সবাই জানি, যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন। বইয়ের জ্ঞান পেট আর পকেটে গড়াগড়ি করতে করতে শিক্ষকেরা চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি করতেও পারদর্শী হয়েছেন। বিবিধ কারণে সিনেমার ভিলেনের মতো শিক্ষক গুণাবলিতেও ভিলেনের গুণে আর্বিভাব। এর সঙ্গে এলাকার দু-চার জন হোমরাচোমরাও পকেটের টানে শিক্ষক হয়েছেন। অনেক শিক্ষক নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে আাদর্শ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। ফলে রাজনৈতিক মোহ তাদের কাবু করে ফেলেছে। এ পেশায় নিরপেক্ষতা কাম্য হলেও চেয়ারের গন্ধ আর ক্ষমতার আবেশ তাদের অন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায়, আজকের যতো সমস্যা তা কী অপ্রাসঙ্গিক?

জোর করে বা কৃত্রিম প্রতিবাদের আন্দোলন করে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ তাও পাতানো। এর পেছনে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী শিক্ষক এবং কৌলিন সমাজের কিছু দোসর। পদত্যাগের যতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে প্রতিটার পেছনের গল্প এমনই রঙচটা। তবে অনেকের দোষ যে নেই তা নয়। তবে তার প্রতিকার বা মীমাংসা কী এমন হবার কথা? স্বৈারচারী শাসক পতনের আন্দোলন আর শিক্ষক হটানোর কৃত্রিম প্রতিবাদ এক কথা নয়। সরকার কয়েকবার এ বিষয়ে সতর্ক করলেও আমাদের ছাত্র সমাজ তা তেমন কর্ণপাত করেনি। যদিও এখন অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে তথাপি এমনটা কারোই কাম্য হতে পারে না। কোনো ছাত্র শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা বা কলার ধরা কিংবা কোনো শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে না। কেনোনা কোনো না কোনো শিক্ষকের শিক্ষা তা তার মধ্যে রয়েছে। তবে আমরা শিক্ষক সমাজ কী শিক্ষা দিলাম? সময় হয়েছে। সজাগ হতে হবে। পেট আর পকেটের চিন্তা কী আমাদের এতোই হীন করে দিলো যে আমরা আদর্শকে কবর দিয়ে কঙ্কালের ছায়ায় তাদের গড়ে তুলছি? রাষ্ট্র সংস্কার কখনোই কার্যকর হবে না যদি আমরা শিক্ষাকে প্রকৃত শিক্ষায় তুলতে না পারি। শিক্ষার অনিয়ম সর্বত্র ছড়ায় যার প্রভাব আমরা দেখছি। নীতিহীন শিক্ষক কোনো শিক্ষার বাহক নয়। এদের পরিবর্তন না হলে আদর্শে পীড়া থেকেই যাবে। শিক্ষকের অর্থচিন্তা সরকার কাঁধে নিলে আদর্শবান শিক্ষক যদি চায় হয় তবেই শিক্ষার্থীর বিবেক মৌলিক হবে। নাহলে শিক্ষার্থীর হাতে লাঞ্ছিত হতে বারবার আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিটি শিক্ষক তার সহকর্মীকে বন্ধু হিসেবে দেখতে হবে। মনে রাখা চাই, আমার জন্য যদি অন্য শিক্ষক লাঞ্ছিত হয় তবে আমার লাঞ্ছনাও প্রাকৃতিকভাবে হবে।

দেশের যতো সংস্কারই হোক না কেনো শিক্ষা সংস্কার সবচেয়ে জরুরি। যে শিক্ষায় নীতি নৈতিকতা পদদলিত হয় তা শিক্ষা নয়। গত কয়েক যুগে শিক্ষার যে অধগতি তা রোধ করার অন্যতম উপায় হলো শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। সেই সঙ্গে আমাদের শিক্ষক সমাজ যদি নিজেদের সংস্কার না করেন তবে ছাত্রের দোষ দিয়ে কী হবে? উত্তরপত্র সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা থেকে শুরু করে ক্লাসের পাঠ সঠিকভাবে সমাপ্ত করার মধ্য দিয়ে আত্মন্নোয়ন সম্ভব নয়। নীতির বোধন কর্মে, প্রাপ্তিতে নয়। কর্মে যা প্রতিফলিত হয় প্রাপ্তি তো তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা পালন করলে কর্তৃত্ব ফলানোর প্রয়োজনও পড়বে না। শিক্ষা সংস্কারের প্রথম সংস্কার হোক শিক্ষকদের নীতি সংস্কারের মাধ্যমে।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, আলহাজ্ব খোরশেদুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়, নারায়ণগঞ্জ

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাদ্রাসার এডহক কমিটিও নিয়োগ দিতে পারবে - dainik shiksha মাদ্রাসার এডহক কমিটিও নিয়োগ দিতে পারবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সোশ্যাল জাস্টিস শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত - dainik shiksha সোশ্যাল জাস্টিস শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047378540039062