শিক্ষকবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত জনগণের বন্ধু ছিলেন। তিনি কৃষক, শ্রমিক মেহনতি মানুষসহ এক কথায় সকলের বন্ধু। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার দুটি লাইন দিয়ে তাঁর ভাবনা উপস্থাপন করতে গেলে বলতে হয়, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। ধর্ম শ্রেণিভেদের ঊর্ধ্বে মানুষ পরিচয়টা তাঁর কাছে বড় ছিল। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর হৃদয়ের গভীর ভালোবাসার কিছু দৃষ্টান্ত আলোকপাত করছি।

বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে এদেশের প্রকৃত মুক্তি আসবে। আর শিক্ষার প্রধান নিয়ামক হলো শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা। তিনি বলেছিলেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষার ব্যর্তয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতার সুফল পাওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, পেন্সিল, দুধ, ছাতু বিতরণের মাধ্যমে প্রাথমিক উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন।


 
তিনি স্বাধীনতার উষালগ্নে স্কুলগৃহ পুনঃনির্মাণ বা মেরামতের জন্য টিন ও নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার আগে প্রাথমিক শিক্ষকদের আর্থিক দুরাবস্থা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই থেকে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেছিলেন। চরম হাহাকারের মাঝে যেখানে খাবারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর নিদারুন সংকট। সেখানে এ প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ দুঃসাহসী পদক্ষেপ। সরকারি কোষাগার থেকে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষকের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেওয়া বিশাল হৃদয় অধিকারীর পক্ষেই সম্ভব। এ সংকটে তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল, টঙ্গী সার্টের কাপড় নায্যমূল্যে কেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সুষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ঠ বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। দারিদ্র যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে ১ম শিক্ষা কমিশন চালু করেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন পাস করেন।


 
বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্বশাসন, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে তিনি সামরিকখাতের চেয়ে শিক্ষাখাতে ৭ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেন। শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ থেকে বোঝা যায় তিনি শিক্ষাকে কত বেশি গুরুত্ব দিতেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে ছাত্ররা কিছু দাবি নিয়ে ঘেরাও করে। বিষয়টি জানতে পেরে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘যারা শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করেছে। আমি তাদের সাথে কোন কথা বলবো না’।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষক তার সাথে সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় তার বাসভবনের গেইটে উপস্থিত হলেন। বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সে খবর পেলেন। তিনি সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে নিজেই ছুটে আসেন এবং স্যারের পা ছুঁয়ে সালামের পর বুকে জড়িয়ে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সেই শিক্ষককে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে নিজের চেয়ারে বসিয়ে উপস্থিত মন্ত্রী, এমপিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গর্ব ভরে বলেছিলেন, আমার শিক্ষক।
 
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালি সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জাতির পিতা জানতে পারলেন, একজন বৃদ্ধ শিক্ষক দেখা করার অনুমতি চান। বিষয়টি শোনা মাত্র তিনি সেই শিক্ষককে তাঁর কাছে আসার অনুমতি দেন। সেখানেই তাঁর সাথে রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পায়ে হাত দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শিক্ষক সমাজকে তিনি এভাবেই সম্মান করতেন।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি সর্বত্রই একটি কথা বলি, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না। মাটি থেকেও গজাবে না। সোনার মানুষ গড়ার কারিগর হলো শিক্ষক এবং কারখানা হলো শিক্ষালয়।

৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালোরাতে আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক শিক্ষক বন্ধুকে হারিয়েছিলাম। বাঙালি হারিয়েছিল শিক্ষা উন্নয়নের প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ককে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুকরণ করে শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রধান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আজও শিক্ষাক্ষেত্রে বহু বৈষম্য মানসম্মত শিক্ষা বিঘ্নিত করছে।

শোকের মাসে শিক্ষাক্ষেত্রের সব বৈষম্য দূর হোক। এ প্রত্যাশা। শিক্ষক বন্ধু জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। বঙ্গবন্ধুসহ ও তাঁর পরিবারের নিহত সকলের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

জয় বাংলা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। বঙ্গবন্ধুর মতো সকলের মাঝে শিক্ষার প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হোক।

লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031440258026123