শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত হোক

মোঃ আশরাফ উদ্দিন |

শিক্ষক দিবসে পৃথিবীর সব শিক্ষকের প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা। বিশেষ করে করোনা মহামারিতে যেসব শিক্ষক করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। শিক্ষক হলেন জাতির কাণ্ডারি। তিল তিল করে নিরবে-নিভৃতে শিক্ষক তাঁর আদর্শ দ্বারা জাতীয় আকাঙ্ক্ষার উপযোগী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলেন। শিক্ষক জাতির পথ প্রদর্শক, আলোর দিশারী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সফলতার বীজ বুনতে শেখান ও সমাজের সূর্য সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তোলেন। সবসময় শিক্ষকরা ছিলেন সমাজের প্রাণকেন্দ্র ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিক্ষকরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মেলা, সভা, গ্রাম্য সালিশ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মিলাদ, বিদ্যালয় মাঠে বিনোদন, খেলাধুলা, লোকগীতি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে শিক্ষকদের সঙ্গে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ করার জন্য এবং শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।

শিক্ষার মূল ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা। দেশের মেরুদণ্ডকে সোজা হয়ে দাঁড় করাতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। গোটা প্রাথমিক শিক্ষাকে সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য সব কর্ম পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের সব বাধা উপেক্ষা করে নীতিনির্ধারকদের সঠিক দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষকরা প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও কিছু সমস্যা যেমন- ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক সংকট ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাব মানসম্মত শিক্ষাদানে বাধা হয়ে থাকে। এছাড়াও বেতন বৈষম্য ও আর্থিক নিরাপত্তা, মানসিক চাপ, হতাশাসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষকরা। অথচ শিক্ষকরা সকল কন্টাকাকীর্ণ এবং ভবিষ্যত বিড়ম্বনার আশঙ্কা সত্ত্বেও শিক্ষকতাকে কোনো সাধারণ চাকরি না ভেবে একটি আদর্শ ও মহান পেশা হিসেবে হৃদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নিয়েছেন। এজন্য তাদের সারা জীবন অভাবের গ্লানি টানতে হলেও আদর্শচ্যুত হতে দেখা যায় না। তাঁরা শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। জাতি শিক্ষকদের কাছে অনেক আশা রাখে। তাই শিক্ষকদের হতে হবে নিবেদিতপ্রাণ। মাঝে মাঝে প্রশ্ন আসে- শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও জীবনযাত্রা কতটুকু সহায়ক? এই শ্রেষ্ঠ পেশার শিক্ষকরা তাদের অধিকার ও মর্যাদা পান কতটুকু? বহু উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে কয়েকদফা শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও পরিবর্তন হলেও আজও তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও সফলতায় শিক্ষকদের মর্যাদা ফুটে ওঠেনি। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষকের জন্য নেই কোন বৈষম্যহীন কার্যক্রম। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকসহ সব শিক্ষকের এ পেশায় প্রবেশের যোগ্যতা স্নাতক করা হলেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো, পদোন্নতি, বিভাগীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে মেধাবী ও সৃজনশীল প্রার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষকতায় আগ্রহী হন না। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব না। প্রতিভাবান, মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী ও আকৃষ্ট করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিত বৈষম্যের কিছুটা অবসান হলেও অভিন্ন বেতন কাঠামো ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের জীবনযাত্রাকে অন্যান্য পেশা ও চাকরি থেকে অধিক মর্যাদা দেওয়ার দাবি রয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষকের মর্যাদা। ম্যানেজিং কমিটির আধিপত্য ও ক্ষমতার দাপটে শিক্ষকরা প্রায় লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছেন, যা শিক্ষকদের মর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করছে। এসব ম্যানেজিং কমিটির যোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে কবি কাদের নেওয়াজের কবিতায় উল্লেখ করা সেই শিক্ষকের মর্যাদা।

অথচ বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে, যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে অধিক সম্মানীয়। পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেক সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। প্রাথমিক শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধিকার, সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে অবহেলিত। পুরা শিক্ষকতা জীবনে একই পদে চাকরি করে অবসর নিতে হয়। নেই কোনো পদোন্নতির ব্যবস্থা, নেই বিভাগীয় প্রার্থী হিসাবে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকরা এদেশের তৃতীয় শ্রেণির চাকরিজীবি হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অবহেলিত। শিক্ষকদের মর্যাদা রাষ্ট্র যদি সমুন্নত কিংবা স্বীকৃতি না দেয়, সেখানে সমাজ কি করে স্বীকৃতি দেবে? শিক্ষকদের মানমর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আর এজন্য দেশের সকল শিক্ষককে অভিন্ন চোখে দেখতে হবে, তাঁদের সকল অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে এ পেশার সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মেধাবীদের  আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হোক শিক্ষকতা, কেউ যেন ঘটনাক্রমে শিক্ষক না হয়।

সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে এ কথাই বলতে হয় যে, শিক্ষকরা এই চরম হতাশার মধ্যে দিনযাপন করছেন। যার ফলে নতুন কিছু সৃষ্টি দূরের কথা, বরং স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও থাকে না। পরিশেষে মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদার স্বীকৃতি, শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর, পদোন্নতির ব্যবস্থা, স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর সুপারিশ করে প্রাথমিকসহ সকল শিক্ষার গুণগত মান বিকশিত করা হবে- বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এ প্রত্যাশা ।

লেখক : মোঃ আশরাফ উদ্দিন, মিডিয়া সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028519630432129