সেই যে মেয়ে, নাটোরের বনলতা সেন, সে যে বলেছিল ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ তার সে-বলার দ্বিধা থরথর বৃন্তে কেঁপেছিল জানি অত্যন্ত গভীর আগ্রহ ও ব্যাকুলতায়; কিন্তু জানা তো ছিল না আমার নয়, হয়তো অনেকেরই নয় যে ওই বলার মধ্যে একটি নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান রয়ে গেছে। কবি-সমালোচক জগন্নাথ চক্রবর্তী জানিয়েছেন এই সত্যটি সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি গবেষণা নিবন্ধে। তার যুক্তি অকাট্য। প্রথম প্রমাণ এতদিন কোথায় ছিলেন কথাটার অর্থ কী? অর্থ এই যে বিলম্ব হয়ে গেছে। লেখাটা পড়ে আমি নীরবে মাথা দোলাই। তাই তো, ওটা তো খেয়াল করিনি। প্রেমিকার হয়তো এতদিনে বিয়েটা হয়ে গেছে, হতে পারে বাচ্চা-কাচ্চাও এসেছে, ঈশ্বরের কৃপায়। এখন তিনি কী করে গ্রহণ করবেন তার প্রেমিককে? এতদিন কোথায় ছিলেন?
দ্বিতীয় প্রমাণটা আরও শক্তিশালী। আপনি বলে সম্বোধন করা হচ্ছে। ‘কোথায় ছিলেন?’ অর্থাৎ সম্পর্কটা এখন আর আগের মতো অন্তরঙ্গ নেই, আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়েছে। ‘আপনি’তে পরিণত হয়েছে। তাই তো, এও তো ঢোকেনি আমার মাথায়। ওই যে সামান্য দন্ত ‘ন’-যাতে ‘ছিলে’ হয়ে যায় ‘ছিলেন’-সে তো সামান্য ব্যাপার নয়; এ তো অনেক কথা বলা; অনেক দূরত্বের, অলঙ্ঘনীয় ব্যবধানের স্মারক সে, যতই নিরীহ-মুখো হোক দেখতে। এরপর কী আর বলার অপেক্ষা রাখে কবি কেন বলছেন, ‘থাকে শুধু অন্ধকার’, ইত্যাদি। প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের জন্য অন্ধকারই তো থাকবে, অন্য আর কী থাকা সম্ভব?
বুঝলাম। মাথা নেড়ে নেড়ে বুঝলাম। কিন্তু পরে-বেশ পরে-দ্বিতীয় চিন্তা এসেছে আমার। আচ্ছা, এমন যদি হতো যে বনলতা সেন খুব জোরেশোরে বলছেন, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে?’ তাহলে কি এর চেয়ে বেশি অন্তরঙ্গতা বোঝাত? অথবা যদি তারা-প্রেমিক ও প্রেমিকা-পরস্পরকে তুই-তুকারি করতেন তাহলেই কি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম আমার যে, তারা খুব কাছাকাছি হয়ে গেছেন পরস্পরের? বোধ হয় না, তুই-তুকারির পক্ষে ঝগড়ার ভাষা হওয়া বিচিত্র নয়, যেমন বিচিত্র নয় ‘আপনি’ বলার পক্ষে অন্তরঙ্গতার পরিচায়ক হওয়া। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক ‘আপনি’ বললে, ‘ন’ ব্যবহার করলে, একটা দূরত্ব বোঝায়।
ভাগ্যিস এই ‘ন’-র ব্যাপারটা ছিল। নইলে আমাদের অনেক গবেষণাই মার খেতো। কিন্তু কেবল গবেষণারই কষ্ট হবে কেন, গবেষণা তো সামান্য ব্যাপার, কষ্ট হতো আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোরও। একেবারে অচল হয়েই পড়ত, অনেক ক্ষেত্রে। সব সমান হয়ে গেলে কি সমাজ চলে? অন্তত আমরা তা বিশ্বাস করি না। আমরা জানি ভারী প্রয়োজন আছে এই উপর-নিচের। আমি যদি আমার উপরওয়ালাকে ‘স্যার’ না বলি, দেখা হওয়ামাত্র চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে না উঠি, তবে উপরওয়ালাই বা উপরওয়ালা থাকেন কী করে, আর আমিই তার নিম্নবর্তী হই কোন উপায়ে? দরকার, খুবই দরকার ওই দন্ত ‘ন’-দের।
আমার যে বন্ধু চীন ঘুরে এসেছেন সদ্য সদ্য, তিনি বলছিলেন তার অভিজ্ঞতার কথা। যখন বিদায় নিচ্ছেন, প্লেনে চাপবেন, তখন চীনের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আবার কবে দেখা হবে? আমার বন্ধু বললেন, যেমন আমরা সচরাচর বলি, উপরওয়ালার ইচ্ছা। চীনা ভদ্রলোক কী বুঝলেন কে জানে, বেশ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শেষে বললেন, ‘ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো’। বলে আবার হাসলেন। সেই হাসি দেখে এসে ভীষণ সন্দেহে পড়েছেন আমার বন্ধু। উপরওয়ালা বলতে তিনি তো বোঝাতে চেয়েছেন ঈশ্বরের কথা, এখন ওই চীনা লোক যদি মনে করে থাকেন অফিসের ‘বসে’র কথা? ভদ্রলোক যদি বলেই ফেলতেন বন্ধুকে উদ্দেশ করে, ‘ঠিক আছে, আপনার উপরওয়ালার সঙ্গে না হয় আলাপ করবো ও-বিষয়ে’ তাহলে? তাহলে কি বিপদ হতো না? প্রশ্ন করে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকেন বন্ধু আমার।
আসল উপরওয়ালা অবশ্য ওই ‘বস’ই। অন্য কেউ নয়। তাকে ছাড়া চলে না।
তার জোরে গরম হই, তার ভয়ে নরম হই। গরমে তিনি, নরমেও তিনি। তিনি যদি না থাকেন অচল হয়ে যাবে সমস্ত কিছু এই মুহূর্তেই। কে দেবে ধমক? আর ধমক না খেলে আমরা চলব অন্য কোন অনুপ্রেরণায়? আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক। এই আমলাতন্ত্র ওই দন্ত ‘ন’-র লাঠির ওপর ভর করেই চলে। মান্য করি বলেই মান্যবর তিনি, নইলে দিগম্বরেরা কে কাকে সালাম করে? কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তারা একটি বিতর্কে জড়িয়েছে। প্রশ্নটা এই শিক্ষা আমাদেরকে আমলাতান্ত্রিক করছে, নাকি আমলাতন্ত্রই এ শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে? খুবই দার্শনিক প্রশ্ন, সন্দেহ কী। আমিও দার্শনিকভাবেই বলি, দুটোই সত্য। মিথ্যা বলিনি কিন্তু। মুরগি আগে না ডিম আগে এ নিয়ে তর্কাতর্কি অচল নয়, কিন্তু তাই বলে মিথ্যা নয় এই সত্য যে, ডিমও সত্য মুরগিও সত্য। আমলারাই শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে এবং শিক্ষাব্যবস্থাও সমানে আমলারা তৈরি করে চলেছে।
আমলা কে? আমলা হচ্ছেন সেই প্রাণী, যিনি ঠিক শাসক নন, সর্বদাই প্রশাসক। বাঁশের চেয়ে যেহেতু কঞ্চি বড়, তাই প্রশাসকের তেজ বেশি শাসকের চেয়ে। উপরওয়ালার কাছে ভিজে ন্যাকড়াটার মতো নরম হন, আর তারই সুদেমূলে ক্ষতিপূরণ আদায় করেন অধস্তন কর্মচারী ও অসহায় জনসাধারণের ওপর ভীষণরকম গরম হয়ে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সংবাদে যে আহ্লাদে আটখানা হবো সেটা হয়ে ওঠে না ওই এক ভয়ে; সারা দেশময় আবার না আমলাতান্ত্রিকতারই কেবল বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে। এবং বাঘের যেমন ফেউ, আমলার তেমনি টাউট। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার কারণে টাউটের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, দেখছেন এই বন্ধ্যাভূমিতে? শিক্ষালয় থেকেই বেরিয়ে আসছেন এরা এই আমলারা। কিন্তু এই শিক্ষালয় কোনো একটি বিশেষ বিদ্যায়তন নয়, দেশজুড়েই এর বিস্তার, সে জন্য দেখা যায় যে, যে-লোক মোটেই শিক্ষিত নয়, কিন্তু পয়সা করে ফেলেছে, পুত্র-কন্যার বিয়ে-শাদির সময় সে ব্যবসায়ী খোঁজে না, আমলাই খোঁজে এবং নিজেও ইচ্ছে করে আমলা হবে, আমলাদের যে সমস্ত ঠাঁটবাট, দবদবা, রবরবা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, আরদালি-বেয়ারা সেই সমস্ত করায়ত্ত করবে। অনেকেই আছে মালিক হতে ভয় পায়, ম্যানেজার হতে চায়। মালিক হলে ঝামেলা অনেক। পরিশ্রম আছে, ঝুঁকি আনে, পুঁজি সংগ্রহের ব্যাপারটা তো রয়েছেই। ম্যানেজার হলে গাছেরটাও পাচ্ছে, তলেরটাও কুড়াচ্ছে।
এমনকি শিক্ষকদেরও অনেককে দেখেছি আমলা হতে পছন্দ করেন। প্রথম জীবনে সরকারি কর্মচারী ছিলেন, পরে শিক্ষক হয়েছেন এমন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সম্পর্কে শুনেছি শিক্ষকতার কাজ নিয়ে সবকিছুই ভালো লেগেছিল তার, লাগেনি কেবল ওই ব্যাপারটা যে বেল টিপলে এখন আর বেয়ারা দৌড়ে আসে না, ঘন ঘন মিটিং থাকে না, যখন-তখন যে-সে তার কামরায় ঢুকে পড়ে হুট করে। এবং সর্বোপরি অধস্তন কর্মচারী নেই গাদাখানেক। অভাবের তালিকাটা অবশ্যি আরও বড় করা যায়, বলা যায় যে চেয়ারের পেছনে তোয়ালেটাও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে আবার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদেরও দেখেছি যে মুহূর্তে সরকার থেকে আহ্বান আসে কোনো চাকরির অমনি আর ধরে রাখা যায় না, অতি দ্রুত গিয়ে হাজির হন। এবং চাকরি শেষে ফিরে এলে বড়ই ম্রিয়মাণ হয়ে থাকেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ব্যবহারটা যে সহজ থাকে, তা-ও নয়। অভিযোগ আছে অনেকেই ভাব করেন নৈর্ব্যক্তিকতার, ছাত্রছাত্রীদের দূরে রাখেন যতটা দূরে রাখা যায়।
নামজাদা শিক্ষকদের বিষয়েও শোনা যায় বিচার করা শেখান না, কেবল বিশ্লেষণ করা শেখান। এটাও হতে পারে, আবার ওটাও হতে পারে বলে নবীন শিক্ষার্থীদের দোদুল্যমান রাখেন। যথার্থ আমলাদের মতো। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামন্তবাদ চলে গেছে হয়তো, কিন্তু তাই বলে সম্পর্কটা মোটেই গণতান্ত্রিক হয়নি। ছাত্রকে সমান মনে করা খুবই কঠিন আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায়, এমনকি উচ্চশিক্ষার স্তরেও তা-ই। সবচেয়ে সহজ, স্বাভাবিক, অনানুষ্ঠানিক এবং কম পোশাকি হওয়ার কথা যে সম্পর্কটা তারই যখন এই দশা তখন অন্যসব সম্পর্ক যে এই সুরেই বাঁধা থাকবে তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়? তা বাঁধা আছেও। সেভাবেই আছে। আমলারা আছেন, আর গো-বিটুইন টাউটরা আছেন। এই যে গো-বিটুইন শব্দটা ব্যবহার করলাম এর বাংলা কী? না, বাংলা নেই।
অনেক শব্দেরই বিকল্প নেই। দেখা তো যাচ্ছে এমনকি ইংরেজিরও কোনো বিকল্প নেই আমাদের জন্য। যে জন্য পারলেই ইংরেজির দিকে ছুটি। ভেতরে এখনো আছে সেই অতিগভীর ও অতিপুরনো আমলাতান্ত্রিকতা। অন্যদের কথা কী বলব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কোনো কোনো শিক্ষককেও দেখি ইংরেজিতে কিছু লিখতে পারলে অত্যন্ত আত্মসন্তুষ্ট হন। শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর রচনাবলির তৃতীয় খন্ড বাংলা একাডেমিই প্রকাশ করেছে। এই খন্ডে আছে লন্ডনে তিনি যে গবেষণার কাজ করেছিলেন সে অভিসন্দর্ভটি এবং বিদেশিদের বাংলা শেখানোর জন্য লেখা একটি বই। স্বভাবতই এগুলো তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন। সেভাবেই তা সংকলিত হয়েছে, কিন্তু এই তৃতীয় খন্ডের যে একটি ইংরেজি ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন, সঙ্গতকারণেই সম্মানিত অধ্যাপক, সেটি সম্বন্ধে বলার আছে দুটি কথা। প্রথমত, এটি না লিখলেও চলত; দ্বিতীয়ত, এটি লেখায় গৌরব না বেড়েছে ওই অধ্যাপকের (তিনিই এই রচনাবলির সম্পাদক) না বাংলা একাডেমির।
লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক দেশ রুপান্তর