শিক্ষা খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি-অরাজকতা দূর করতে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে চলেছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের বিদ্যমান শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন ও পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হয়েছে ২০২২ সালে আর বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী বছর ২০২৩ সাল থেকে। ২০২৫ সালে নতুন এই শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে চলছে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ। একটি গুণগত এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রমে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন।

শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়নে যে আভাস পাওয়া গেছে তা থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার। যথা- ১. পাঠ্যপুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন, ২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ৩. দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দান বাধ্যতামূলক, ৪. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, ৫. মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন বর্জন, ৬. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার, ৭. জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য প্রদান, ৮. নৈতিক শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দান, ৯. প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার এবং ১০. মানসম্মত কারিকুলাম নিশ্চিতকরণ। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই বা অভিন্ন বিষয় পড়ার সিদ্ধান্তটি একদিকে প্রশংসিত হচ্ছে, অন্যদিকে সমালোচিত হচ্ছে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে একই বা অভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। এনসিটিবি জানাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সবাইকে সমভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ থাকবে। সবাইকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় পড়াতে গিয়ে বিজ্ঞানের আবশ্যকীয় অনেক বিষয়বস্তু ছেঁটে ফেলতে হয়েছে; যেটি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ এমনিতেই কম। প্রতিবছর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমছে। যেখানে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব সামনে রেখে, বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন, সেখানে কেন বিজ্ঞানের প্রতি গুরুত্ব কমানো হলো, তা বোধগম্য নয়। গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারলে তা নানাভাবে সহায়ক হয়।

কিন্তু সেটি না করে এমন কিছু বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারবে কি-না, প্রশ্নসাপেক্ষ। একটি শিক্ষাক্রমে কিছু লুক্কায়িত বিষয় থাকে, থাকে সহশিক্ষাক্রমিক বা অন্যান্য কার্যক্রম। সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকলে অনেক বিষয় সরাসরি পাঠ্যপুস্তকে না রেখেও পরোক্ষভাবে এবং বিদ্যালয়ে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে শেখানো যায়। যেমন- মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নামে একটি বিষয় রয়েছে, যেটি শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে বা বিষয় হিসেবে লেখাপড়া করে মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বাড়ানো যাবে, এটি সম্ভবত একটি আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে থাকবে। এর আগে প্রতিটি ধর্ম বইয়ের সঙ্গে নৈতিকতা শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছিল। তাতে কি শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি নৈতিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে?

বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এই পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। কিছু বিষয় অবশ্য নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ধারাবাহিক বা গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখতে হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা না থাকার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। এই পরিসর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা না থাকার সিদ্ধান্তটি সার্বিকভাবে শিক্ষার মান উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হবে।

ইতিবাচক হলে নীতিনির্ধারকরা আগামী দিনে বার্ষিক পরীক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উঠিয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করতে পারেন। নতুন শিক্ষাক্রমের যে কয়টি বিষয় বিস্মিত করেছে, তার অন্যতম হচ্ছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটো পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ পরপর তিন বছর তিনটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর কথা প্রায়ই বলা হচ্ছে নানা মহল থেকে। সরকারও প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করার কথা বলছে। সেখানে এইচএসসিতে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়বে, শিক্ষার্থীরা আরো বেশি করে পরীক্ষামুখী হবে। লেখাপড়ার আয়োজন হবে গৌণ, বাড়বে প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ার হার। সব মিলিয়ে এ সিদ্ধান্তটি মাধ্যমিক শিক্ষায় খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে।

শিক্ষা নীতিমালা ২০১০-এ যে নির্দেশনাগুলো আছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে আর কোনো বাধা থাকবে না। বারবার সিলেবাস পরিবর্তন, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করলে শিক্ষার্থী সেটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তাই একটি স্থায়ী ও মানসম্মত শিক্ষাক্রম, যুগোপযোগী সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকদের ভালো বেতন না দিতে পারলে গুণগত শিক্ষার প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক ভালো দিক আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে বড় বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি না করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। শিক্ষা খাতে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অরাজকতা দূর করতে হবে। শিক্ষাবিদদের শিক্ষা খাতের চালিকাশক্তি হিসেবে নিয়ে আসতে হবে। দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এক ধরনের নয়। শিক্ষায় সমতা আনতে হলে সমগ্র শিক্ষাকে জাতীয়করণ করতে হবে।

লেখক: মো. আরফাতুর রহমান (শাওন), শিক্ষক, মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039489269256592