কোভিড-১৯ সংকট এখনো কেটে যায়নি। এরই মধ্যে পালিত হচ্ছে আরেকটি বিশ্ব শিক্ষক দিবস। গত বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিলো ‘শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা।’ আর এ কারণেই শিক্ষকদের সফল নেতৃত্ব শিক্ষার সংকট কাটাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে, যার ধারাবাহিকতায় শিক্ষক দিবস-২০২১ এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার মূলে রয়েছেন শিক্ষকরাই।’ করোনাকালে আলোচ্য প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে শিক্ষা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের অবদানের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। ইউনেস্কো করোনা মহামারির এ মহাসংকটে শিক্ষকদের প্রত্যয়াবদ্ধ পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষক দিবসের জন্য এই প্রতিপাদ্যটি নির্ধারণ করেছে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপনের জন্য এবার ইউনেস্কো ও এর সহ-সংগঠন, আইএলও, ইউনিসেফ, এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই), বিশ্বব্যাংক, হামদান ফাউন্ডেশন, টিটিএফ, গ্লোবাল এডুকেশন কোয়ালিশন এবং ইন-কান্ট্রি লোকাল এডুকেশন গ্রুপ-এর সদস্যরা সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এদিক থেকে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসটি তাৎপর্যপূর্ণ।
শিক্ষকরা কোনোকালেই বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষাদান পেশাটি তাদের আদর্শের এক মহৎ ব্রত। যার ফলে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট শিক্ষার ব্যাঘাত এবং স্কুল বন্ধ হওয়া সত্বেও শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শিক্ষকরাই নিবেদিত চিত্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, নিজেদের পরিবার এবং স্থানীয় সাধারণ সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক গতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান সংকটের সময় দেখা গেছে, শিক্ষকরা শিক্ষাগত প্রতিক্রিয়াগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন; তারা অনলাইনে শিক্ষাদান এবং শেখার ব্যবস্থা করেছেন; তারা গ্রামীণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের জন্য টেকহোম প্রজেক্ট বা হোম স্কুল প্রস্তুত করেছেন, অথচ সেখানে অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ এবং প্রযুক্তির অভাব রয়েছে; তারা তাদের চর্চা অভিযোজিত করেছেন এবং শিক্ষার ফরম্যাট, মাধ্যম এবং বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য এনেছেন, যাতে তাদের সামাজিক-মানসিক সুস্থতাসহ শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করা যায়; এছাড়াও তারা শিক্ষার্থী, সহকর্মী শিক্ষক এবং স্কুল সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা আরো জোরদার করেছেন। তারা প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন, পরীক্ষা নিয়েছেন এবং শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপাদান বিনিময় করে শিক্ষাসংকট দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাধারণ সম্প্রদায় এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে শিক্ষকদের অবদানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শিক্ষার পুনরুদ্ধারে এবং সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে তাদের অবদান সর্বমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষকদের কাজের প্রতি এ উচ্চ সম্মান, শিক্ষা সম্প্রসারণের নীতিমালা এবং শিক্ষা পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। (রিপোর্টঃ ইউনেস্কো, ২০২১)।
করোনাকালীন সংকটে শিক্ষকতা পেশার জন্য শিক্ষকদের অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে; অনলাইন শিক্ষায় পেশাগত উন্নয়নে সুযোগের অভাব, দূরশিক্ষা, ডাবল-শিফট ক্লাস এবং ব্লেন্ডেড লার্নিংয়ের সঙ্গে যুক্ত কাজের চাপ বৃদ্ধি। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়োগ করে স্থায়ীদের বরখাস্ত করা, বেসরকারি স্কুল এবং কমিউনিটি স্কুলে মাসের পর মাস শিক্ষকদের বিনা বেতনে চাকরি করা বা কখনো কখনো চাকরি থেকে বিদায় করে দেয়া ছিলো আরো দুঃখজনক। পেশাগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যখন শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মীদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন স্কিমগুলোতে ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসেবে যতটুকু অগ্রাধিকার দেয়া দরকার তা যথার্থভাবে দেয়া হয়নি। ফলে আজকাল শিক্ষকদের মর্যাদা এবং পেশাগত সামাজিক অবস্থান ও পর্যাপ্ত সহায়তা সামগ্রিক অর্থায়নে প্রতিফলিত হয় না। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষকদের খুব কমই আমন্ত্রণ জানানো হয়। অথচ শিক্ষার্থীদের শেখার এবং সুস্থতার ওপর শিক্ষকদের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং শিক্ষাজীবনের বাইরেও এককভাবে এসব শিক্ষকদের গুণমান অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যা শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বকে প্রভাবিত করে।তবু শিক্ষকরা সমাজে অবমূল্যায়িত এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশ অবহেলিত। আর এ কারণেই আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশা মেধাবীদের কাছে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে বিবেচিত হয় না।
এ পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক কারণ শিক্ষকদের অভাব এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকস (ইউআইএস)-এর রিপোর্ট অনুসারে, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সার্বজনীন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য (এসডিজি-৪.১) বিশ্বব্যাপী আরো ৬৯ মিলিয়ন শিক্ষক প্রয়োজন; প্রাথমিকের জন্য ২৪ মিলিয়ন এবং মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ৪৪ মিলিয়ন। আফ্রিকাতে শিক্ষকসংকট সবচেয়ে তীব্র, যেখানে শিক্ষকসংকট রয়েছে ৭০ শতাংশ প্রাথমিক স্তরে এবং ৯০ শতাংশ মাধ্যমিকে। এখনি এ সংকট দূর করতে না পারলে আগামী ৩০ বছরে এ অঞ্চলটি এক মহা শিক্ষাসংকটে পড়বে। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, ইউআইএস-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সাব-সাহারান আফ্রিকার ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ১৭ মিলিয়ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন, দক্ষিণ এশিয়ার ১৫ মিলিয়ন এবং উন্নত দেশগুলোতে ১১ মিলিয়ন নিয়োগ করা প্রয়োজন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫১টি। এসব প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষকের মোট সৃষ্ট পদ রয়েছে ১০ হাজার ৯০৪টি। এর প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষকের পদই শূন্য রয়েছে। প্রাথমিকের অবস্থা আরো শোচনীয়।
করোনকালে শিক্ষার পুনরুদ্ধারের জন্য, ভবিষ্যতের ধাক্কাগুলোর বিরুদ্ধে স্থিতিস্থাপক নির্ধারণ করে আরও অভিযোজিত শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকাই মোক্ষম। এ জন্যই গ্লোবাল এডুকেশন মিটিং-এর মিনিস্টারিয়াল সেগমেন্ট-এর পরামর্শ মোতাবেক, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সব শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মীদের ফ্রন্টলাইন কর্মী হিসেবে সহায়তা দেওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রতিনিধি সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং তাদের নিরাপত্তা, সুস্থতা ও কর্মক্ষেত্রের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এ কারণেই ইউনেস্কো, ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাংক 'মিশন: ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা পুনরুদ্ধার' নামে একটি যৌথ মিশন চালু করেছে, যার মূল লক্ষ্য হলো, শিক্ষকদের সহায়তার ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা, সমস্ত শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো এবং তাদেরকে শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করা।
শিক্ষার পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন খুবই জরুরি। এজন্য নীতি নির্ধারকদের উচিত হলো, শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের মানোন্নয়নে সর্বদা সমর্থন করা, প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের শিক্ষাগত সিদ্ধান্তের ওপর বিশ্বাস রাখা এবং শিক্ষাকে সহায়তা করার জন্য শিক্ষাগত প্রযুক্তি ব্যবহার করার দক্ষতা বৃদ্ধি করা, হাইব্রিড শিক্ষার সকল সরঞ্জাম নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন চাহিদা, ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনযোগ দেয়া। এছাড়া বাধাগ্রস্ত শিক্ষার ক্ষতি কাটাতে শিক্ষকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হয় তাহলো সম্পূরক শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেওয়া, সঠিক স্তরে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিখনফল নিশ্চিত করা, শিক্ষার প্রাসঙ্গিককরণ এবং মহামারী চলাকালীন শিক্ষার ক্ষতি এবং লাভগুলো বিবেচনায় নেওয়া। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। যেমন, শ্রেণীকক্ষ পর্যায়ে শিক্ষার মূল্যায়ন এবং পাঠ্যক্রমকে শিক্ষার্থীদের চাহিদার সঙ্গে মানানসই শিক্ষার সমন্বয় করা। এগুলো এমন পদক্ষেপ যা শিক্ষকদের সচেতনতার সঙ্গে অনুশীলন করতে হয়, যেন ভবিষ্যতের সংকটগুলোর জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়া যায় এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের সুবিধাগুলো গ্রহণ করে শিক্ষা পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা যায়।
যখন শিক্ষা প্রশাসন এবং অংশগ্রহণের কথা আসে, তখন শিক্ষাব্যবস্থার সামনে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি দেখা যায় সেটি হলো শিক্ষাকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষক এবং তাদের সংগঠনের অংশগ্রহণের জন্য চ্যানেল তৈরি করা ও শ্রেণীকক্ষে তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বিতরণ করা। শিক্ষা প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরে, সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের অংশগ্রহণ, নেটওয়ার্ক এবং অনুশীলনের সম্প্রদায়গুলিতে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা শিক্ষকদের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব।
কাজের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, শিক্ষকদের স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ এবং সক্রিয় পরিবেশে এমনভাবে কাজ করতে হবে যা লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যহীনতাসহ কুসংস্কারমুক্ত, উপযুক্ত কর্মঘণ্টা অনুযায়ী পারিশ্রমিক এবং ক্যারিয়ার বিকাশের সুযোগ-সুবিধা দ্বারা সুসজ্জিত। এটি কেবল পেশার মর্যাদাকেই উন্নীত করবে না, বরং এটি নিয়োগ, ধারণ, প্রেরণা এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতি করবে।
অতএব, পরিশেষে বলা যায়, কোভিড -১৯ সংকটের দীর্ঘকাল পর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে শিক্ষকদের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি অবদান রাখার জন্য যে সহায়তা দেওয়া দরকার তার উপর আলোকপাত করতে হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের অবস্থা মূল্যায়ন্রে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেতনা অনুসরণ করে, এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের পর্যবেক্ষণ শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের ভূমিকাকেই ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সুতরাং ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের এসডিজি লক্ষমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করার জন্য তাদেরকে পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে এবং শিক্ষা পুরুদ্ধারের জন্য তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর ডক্টর মোঃ মাহমুদুল হাছান, গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা