শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থেমে নেই যৌন হয়রানি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের শিক্ষাঙ্গণে দিনকে দিন যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলছে। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও থেমে নেই যৌন হয়রানি। উচ্চ আদালতের নির্দেশ মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি থাকার কথা কিন্তু এর কার্যকারিতা কেবল কাগজে কলমেই। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়নি। আবার কমিটি গঠন করা হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই প্রতিরোধ কমিটি সম্পর্কে জানেন না। শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ছেলে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকরা এখন এসব ঘটনায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। বুধবার (৭ সেপ্টম্বর) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন জিন্নাতুন নূর।

প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয়ভাবে যৌন হয়রানির মতো ঘটনার মীমাংসা করা হচ্ছে। কখনো কখনো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), জেলা ও থানা শিক্ষা অফিসে দু-একটি অভিযোগ জমা পড়লেও শিক্ষা কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি থাকার কথা। তবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো এই কমিটি গঠন করা হয়নি। ঢাকার বাইরে এ ধরনের কমিটি গঠনের ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগ্রহও কম। আবার এসব ঘটনায় সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলকব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। নীতিমালা না থাকার কারণে এসব ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌন হয়রানি বন্ধে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। যা খসড়া পর্যায়ে আটকে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও উপপরিচালক মৌলি আজাদ বলেন, দেশের হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের কাছে নিয়মিত প্রতিরোধ কমিটির প্রতিবেদন পাঠায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত জানায়ও না। আমাদের কাছে অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছে যে, তারা এ ব্যাপারে জানে না।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক আবু সুফিয়ানের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা গত ২৩ আগস্ট মেয়েকে যৌন হয়রানি করা হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। গত ৩১ আগস্ট সহকারী কমিশনার আল আমিন হালদারকে অভিযোগটি তদন্ত করার দায়িত্ব দেন বিভাগীয় কমিশনার। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটির কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। এখন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষক সংযুক্ত থাকবেন। কোনো ক্লাস নিতে পারবেন না।

মাদারীপুর সদর উপজেলায় শ্রেণিকক্ষে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। একান্ত সময় কাটানোর জন্য বাসায় যেতে রাজি না হওয়ায় ছাত্রীদের মারধর করেন অভিযুক্ত ব্যক্তি। গত ১৯ মার্চ মাদারীপুরের চরমুগরিয়া নেছারিয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক আবদুর রহিম শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য যান। এ সময় তিনি সপ্তম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে তাদের যৌন হয়রানি করেন। শুধু শ্রেণিকক্ষেই নয়, পাঠদান শেষে একান্ত সময় কাটানোর জন্য ছাত্রীদের তার বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন অভিযুক্ত শিক্ষক। এতে রাজি না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। পরদিন প্রতিষ্ঠানের সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ১৩ শিক্ষার্থী। কিন্তু এই ঘটনার আড়াই মাসেও বিচার পায়নি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে এক স্কুলশিক্ষকের বিরুদ্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের ১৫ মার্চ উপজেলার জয়নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিজানুর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ভুক্তভোগী জানায়, বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান মোল্লা দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করে আসছিল। ১৫ মার্চ ক্লাস চলাকালীন ১০ম শ্রেণির এক ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। এই ছাত্রী বিষয়টি তাৎক্ষণিক মৌখিকভাবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জানায়। ছাত্রীটির মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষক মিজানুর রহমানকে স্কুল থেকে বের করে দেন প্রধান শিক্ষক। টাঙ্গাইলের সখীপুরে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার দায়ে গত ১৪ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে এক মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। জানা যায়, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতেন। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বলা হলেও তিনি নিজেকে সংশোধন করেননি। এ বিষয়ে ইউএনও ফারজানা আলম জানান, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।

এদিকে চলতি বছরের মে মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনামুল হকের বিরুদ্ধে দুই সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে। বিভাগীয় শিক্ষকরা জানান, অধ্যাপক এনামুল হক প্রথমে এক শিক্ষককে যৌন হয়রানি করেন। পরে বিভাগের আরেক শিক্ষককে উদ্দেশ করে এনামুল একই আচরণের পুনরাবৃত্তি করলে সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই শিক্ষক। অভিযোগে বলা হয় অধ্যাপক এনামুল হক কর্মস্থলে সহকর্মীদের যৌন হয়রানি করে নৈতিক স্খলন ঘটিয়েছেন। এই অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল সেলের মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, ভালো-মন্দ এবং নৈতিকতার শিক্ষা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকেই পাই। কিন্তু একজন শিক্ষকের মাধ্যমে যখন শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তখন তার আদৌ শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আছে কিনা ভাবতে হবে। বেশিরভাগ সময় যৌন হয়রানির শিকার মেয়েদের নীরবে এসব সহ্য করে যেতে হতো। কিন্তু এ বিষয়ে আগের চেয়ে মেয়েরা এখন বেশি সোচ্চার। ফলে এ ধরনের ঘটনা এখন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026559829711914