শিক্ষা বিভাগকে ‘নন-ভ্যাকেশন’ ঘোষণার দাবি

মো. ওমর ফারুক |

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের প্রথম খণ্ডের বিধি বিধি-৫ (৫৮) অনুযায়ী অবকাশ বিভাগ বলতে এরূপ বিভাগ বা বিভাগের অংশবিশেষকে বোঝায় যেখানে নিয়মিত অবকাশ অনুমোদিত এবং কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা অবকাশকালীন কর্মে অনুপস্থিত থাকতে অনুমতিপ্রাপ্ত। অথচ বেশ কিছুকাল ধরে এই বিভাগের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? গত গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল করে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রাখা হলো, তখন বলা হয়েছিলো শীতকালীন ছুটির সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সমন্বয় করা হবে কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন থাকায় শীতকালীন অবকাশ ও আর ভোগ করার সুযোগ হয়নি এই বিভাগের গণকর্মচারীদের।

আবার সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে পবিত্র মাহে রমজানে ও পনের দিন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও জনস্বার্থে জনৈক আইনজীবী রমজানে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে বিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিলে নির্বাহী সিদ্ধান্তের দোহাই দিয়ে এবং সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তে বিদ্যালয় খোলা রাখা হয়েছে-মর্মে সর্বোচ্চ আদালতকে অবহিত করার মধ্য দিয়ে আপিল বিভাগের মাধ্যমে মাহে রমজানের ছুটি বাতিল করে ১৫ রমজান পর্যন্ত বিদ্যালয় এর কার্যক্রম চলবে মর্মে আপিল বিভাগ থেকে রায় দেয়ার মধ্য দিয়ে মন্ত্রনালয়ের ঐ আদেশ কার্যকর করা হলো। গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন ছুটির পাশাপাশি মাহে রমজানের অর্ধেক ছুটি ও বাতিল করা হলো।

অবশ্য জাতীয় স্বার্থে এবং জাতির বৃহত্তর কল্যাণে শিক্ষকেরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং যথাযথভাবেই তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে শিক্ষকদের আপত্তি ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট নিয়ে। উল্লেখ্য, ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট বাদে অন্য ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতি ১১ দিনে ১ দিন পূর্ণ গড় বেতনের ছুটি পান কিন্তু ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত গণকর্মচারীরা ১২ দিনে ১ দিন ছুটি পান; তবে তা আবার অর্ধ গড় বেতনে।

এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে শিক্ষকেরা দাবি করেছেন। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত একজন কর্মী ২৪ দিনে একদিন পূর্ণ গড় বেতনে ছুটি পান। এদিকে, নন-ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত একজন গণকর্মচারী বছরে ছুটি ভোগ করেন (শুক্র, শনি X ৫২ সপ্তাহ = ১০৪ প্লাস সরকারি সাধারণ ছুটি ২৪ দিন) ১২৮ দিন। অন্যদিকে, ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ছুটি শুক্র ও শনিবারের সাধারণ ছুটি বাদে অতিরিক্ত ৭৬ দিন (যার মধ্যে সরকারি ছুটি রয়েছে ২৪ দিন), উল্লেখ্য সরকারি ছুটির এই ২৪ দিনের মধ্যে আবার জাতীয় দিবসসমূহে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে এবং বিদ্যালয়ের বাইরে প্রশাসনিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে নানা রকম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং অনুষ্ঠান উদযাপন করতে হয়।

এর বাইরে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অবকাশ এর ছুটি বাতিল করা এবং সর্বশেষ মাহে রমজানের ছুটি অর্ধেক বাতিল হওয়ার কারণে রমজানের ১৫ দিন এবং দুর্গা পূজার ৭ দিন ব্যতীত এই বিভাগে কর্মরত গণকর্মচারী হিসেবে শিক্ষকেরা উল্লেখযোগ্য কোনো ছুটিই এবার ভোগ করতে পারেননি। মাঝখানে ভ্যাকেশন নামের এই তকমাটা সঙ্গে জুড়ে থাকার কারণে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়ছেন।

ওপরের আলোচিত এই বিষয়গুলো হয়তো অভিভাবক এবং দেশের সাধারণ মানুষ জানেন না বা তাদের জানার বিষয়ও নয়। কিন্তু এই জাতীয় সাধারণ মানুষদের প্রায়ই বলতে শোনা যায় শিক্ষকেরা বসে বসে বেতন খান, যা শুনতে একজন শিক্ষক হিসেবে আমারও ভালো লাগে না। কারণ, আমরা শিক্ষকেরা কখনোই বসে বসে রাষ্ট্রের বেতন ভোগ করি না। কারণ, আমরা যখন ছুটিতে থাকি তখনো আমরা বিভিন্ন প্রকার দাপ্তরিক দায়িত্বের পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ডের এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ নানা ধরনের কো-কারিকুলার একটিভিটিসের সঙ্গে সাময়িক পরীক্ষা, ষান্মাসিক, বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত তটস্থ থাকি। তটস্থ বললাম এজন্য যে খাতা মূল্যায়নের জন্য ন্যূনতম যেটুকু সময় প্রয়োজন বিদ্যালয়ের অন্যান্য দায়িত্বের পাশাপাশি ওই পরিমাণ খাতা দেখার জন্য বরাদ্দকৃত সময় খুবই অল্প।

উল্লেখ্য, শিক্ষার পাশাপাশি বিচার বিভাগও ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট বলে আমরা জানি কিন্তু সেখানে কি নির্বাহী আদেশে বা কোর্টের মাধ্যমে তাদের ছুটি কমিয়ে বা কোনো গেজেটেড ছুটি বাতিল করা হয়? তারাও তাদের ভ্যাকেশনের সময়কে কাজে লাগিয়ে ঠান্ডা মাথায় জাজমেন্ট লিখে থাকেন। এটা লেখার জন্য যেমন ভ্যাকেশনকে কাজে লাগিয়ে থাকেন এবং বৈজ্ঞানিক কারণেই এই অবকাশের প্রয়োজনও রয়েছে। একইভাবে দেশের ভবিষ্যৎ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্যেও স্থির মস্তিষ্কে মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি। আর সেজন্যই মূলত বিচার বিভাগ ও শিক্ষা বিভাগকে ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করা হয়েছিলো।

কিন্তু বিধি বাম! দেশের সাধারণ মানুষের ন্যায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কর্তা ব্যক্তিদেরও অবৈজ্ঞানিক ধারণা রয়েছে। আর তা হলো শিক্ষকদের আবার ছুটি লাগে নাকি? আর তাদের এতো টাকা-পয়সারই বা দরকার কেনো। এমন বদ্ধমূল অবৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে যতোদিন না রাষ্ট্রের পরিচালকরা বেরিয়ে আসবেন ততোদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার কারিগর শিক্ষকেরা যেমন তাদের মর্যাদার আসনে পৌঁছাতে পারবেন না তেমনি একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনও হয়তো সম্ভব হয়ে উঠবে না বলে আমরা আশঙ্কা করছি।

বর্তমান বাস্তবতায় সারা দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের এই বিভাগে কর্মরত শিক্ষকেরা সোচ্চার হয়েছেন এজন্য যে, তারা আর ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট নামের তকমাটা রাখতে চান না। তাই, কর্তৃপক্ষের কাছে শিক্ষকদের দাবি, দয়া করে এবার এই ভ্যাকেশনের তকমাটা উঠিয়ে দিন। কারণ, আমরা শিক্ষকেরা উল্লেখ করার মতো কোনো ছুটিই ভোগ করতে পারছি না অথচ ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট নামের তকমাটা ওন করায় পেনশনার হিসেবে অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে বরাবরই শিক্ষকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন। এটা সুস্পষ্ট বৈষম্য। যা থাকা উচিত নয়।

অন্যদিকে এই ভ্যাকেশান ডিপার্টমেন্টের তকমা থাকায় শ্রান্তি বিনোদন ভাতা নেয়ার ক্ষেত্রেও অবকাশ দেখে (প্রতি তিন বছর অন্তর) ভাতা উত্তোলনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু অন্য ডিপার্টমেন্টে এই অবকাশের প্রয়োজন হয় না। তারা তাদের ডিউ টাইমেই শ্রান্তি বিনোদন ভাতা উত্তোলনের সুযোগ পান। শিক্ষকদের বক্তব্য, তারা সেবা দিচ্ছেন, দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন। তাই তারা আর অতিরিক্ত কোনো ছুটি চান না। গণ-কর্মচারী হিসেবে অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট-এর মতো সমান সুযোগ লাভ করে যথাযথ সম্মান ও আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে তারা বাচতে চান।

বাংলাদেশের শিক্ষকদের দাবি, প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও নন-ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হোক।

লেখক: শিক্ষক, সরকারি করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038549900054932