শিক্ষা সংস্কারে কতিপয় প্রস্তাব

আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

‘শিক্ষা’ হলো মানুষের আচরণগত ইতিবাচক পরিবর্তন। শিক্ষা বলতে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন তথা দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক বিকাশ এবং কর্মদক্ষতা, সামাজিক ও অবসরযাপনের ক্ষমতার বিকাশকে বোঝায়। ‘শিক্ষা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু হতে। ‘শাস’ ধাতুর অর্থ হচ্ছে শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ দান করা ইত্যাদি। শাব্দিক অর্থে ‘শাস’ কথাটিতে একটি আরোপিত ব্যবস্থার ইঙ্গিত রয়েছে। ‘শিক্ষা’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ হতে। ল্যাটিন ভাষায় Education সংক্রান্ত বিষয়ে তিনটি মৌলিক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়- ‘Educare, Educere Ges Educatum’। শিক্ষাবিদ Mackenzie শিক্ষার ব্যাপক অর্থ সম্পর্কে বলেন-‘শিক্ষা হচ্ছে একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, জীবনের সব রকম অভিজ্ঞতাই এই শিক্ষাদানের ব্যাপারে সহায়তা করে।’ বর্তমান ধারণা অনুযায়ী শিক্ষকের কাজ হলো শিশুকে যথোপযুক্ত জীবন বিকাশে নির্দেশনা দিতে সাহায্য করা। শিক্ষার এই ব্যাপক অর্থকে ভিত্তি করেই আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে।

সব যুগে সব সমাজে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ কিন্তু এক থাকেনি। যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও প্রয়োজনের সম্মুখীন হয়েছে। পরিবর্তিত পরিবেশ ও প্রয়োজনের তাগিদে মানুষকে নিজ জীবনাদর্শের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে নিতে হয়েছে। কোনো একটি দেশের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সে দেশের জাতীয় আদর্শ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং সমাজের প্রয়োজনের নিরিখে নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব কমিশন ও কমিটি সংবিধানের নির্দেশনা বিবেচনায় রেখে দেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও রাষ্ট্রীয় আদর্শ, দর্শন ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছে।

উন্নত জীবনযাপন ও সমাজের নানাবিধ কাজের অগ্রগতি আনয়নে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। আধুনিক অর্থে যেকোনো শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনাকেই বলা হয় শিক্ষাক্রম। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম রূপরেখা উন্নয়ন জরুরি। বাংলাদেশকে তার বিশাল জনগোষ্ঠীর জনমিতিক সুফল পেতে হলে এ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। আর সেজন্য শিক্ষার আধুনিকায়ন ছাড়া উপায় নেই। আর এই আধুনিকায়নের শুরুটা হতে হবে অবশ্যই একটি কার্যকর যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে যা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষাদান কার্যক্রম শিক্ষাক্রম পরিকল্পনারই অংশ। এর মধ্যে কতগুলো শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের ভিতরে শিক্ষকের নির্দেশনায় অর্জন করে। বাকিগুলো শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষকের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে অর্জন করতে পারে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলো অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাজগুলোকে সহশিক্ষাক্রমিক কাজ বলা হয়। যেমন- খেলাধুলা, অভিনয়, বিতর্কসভা, বৃত্তিমূলক কাজ, শিক্ষা সফর ইত্যাদি।

জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে পরিবর্তনশীল আমাদের এই বিশ্বে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পর্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আমাদের কর্মসংস্থান এবং জীবনযাপন প্রণালীতে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। এতে একদিকে যেমন প্রচলিত কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে তেমনি নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে অনেক নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে যা এখনও আমরা জানি না। 

পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও এখনও রয়ে গেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষার মত মৌলিক সমস্যাবলি। যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ, অভিবাসন এবং জাতিগত সহিংসতার মতো সমস্যা আজ অনেক বেশি প্রকট। দেখা দিচ্ছে কোভিড ১৯-এর মতো মহামারি। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় সংযোজিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। এসব চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তার টেকসই ও কার্যকর সমাধান এবং আমাদের জনমিতিক সুফলকে সম্পদে রূপান্তর করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য প্রয়োজন জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দূরদর্শী, সংবেদনশীল, অভিযোজন-সক্ষম, মানবিক এবং যোগ্য দেশপ্রেমিক বিশ্ব নাগরিক। 

বিশ্বনাগরিকত্ব বলতে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বোঝায়, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী একটি শান্তিপূর্ণ, সহনশীল, একীভূত, সুরক্ষিত এবং টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হবে। শিক্ষাক্রমে বিশ্বনাগরিকত্বকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা স্থানীয়, জাতীয়, ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে অবগত হয়ে বিভিন্ন দেশ ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ ও নির্ভরশীলতা সম্পর্কে অবগত হয়; এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা, সংহতি ও শ্রদ্ধাবোধ ধারণ করার মাধ্যমে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করে।

শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর করা কর্তব্য বলে বিবেচনা করি। সেগুলো হলো : (১) শিক্ষাক্রম রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞান অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শনাক্ত করে। তাই একটি বাস্তবসম্মত শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। (২) সমাজ ও ব্যক্তির প্রয়োজনানুসারে শিক্ষার বিষয়বস্তু চিহ্নিত ও বিন্যস্ত করতে হবে। (৩) শিক্ষার্থীদের ধারণ-ক্ষমতা অনুসারে শিখন কাজের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। (৪) বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসঙ্গত উপায়ে বিষয়বস্তু বিন্যাস করতে হবে। (৫) বিষয়বস্তুর পারম্পর্য এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা ও সমন্বয়সাধন করতে হবে। (৬) শ্রেণি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণকে জোরদার ও নিশ্চিত করতে হবে। (৭) বিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন প্রকার কর্মতৎপরতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সর্বমুখী অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। (৮) প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, লাইব্রেরি ও বিজ্ঞানাগার স্থাপন করতে হবে। (৯) শিক্ষকদের পেশাগত ও প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করতে হবে। (১০) শিক্ষকদের মানসিক সুস্থতা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের জন্য বদলি চালু ও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রদান করতে হবে। 

সবার জন্য একীভূত ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ‘(SDG)’ বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সরকারের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়ণের জন্য শিক্ষা হচ্ছে প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাদ রেখে প্রজাতন্ত্রের যত উন্নয়ন করা হোক না কেনো তা সুফল বয়ে আনবে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার এখন প্রজন্মের দাবি। 

লেখক: এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ শিক্ষার্থীদের ব্র্যান্ডিং প্রোডাক্ট হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ব্র্যান্ডিং প্রোডাক্ট হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ মাদরাসার এমপিও নীতিমালা সংশোধনের দাবি - dainik shiksha মাদরাসার এমপিও নীতিমালা সংশোধনের দাবি তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে ভাসানীর জীবনী অন্তর্ভুক্তির দাবি - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ে ভাসানীর জীবনী অন্তর্ভুক্তির দাবি পাঠ্যবইয়ে ভাসানীর জীবনী অন্তর্ভুক্তির দাবি - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ে ভাসানীর জীবনী অন্তর্ভুক্তির দাবি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0060019493103027