শিক্ষাক্রম: আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধ

গুরুদাস ঢালী |

শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম হচ্ছে, শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটাতে গৃহীত শিক্ষা পরিকল্পনা। ইংরেজি শব্দ কারিকুলাম-র বাংলা অর্থ পাঠক্রম, পাঠ্যক্রম, শিক্ষাক্রম। তবে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রম হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। শিক্ষাক্রম কথাটিকে শিক্ষাবিদরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাই এর স্বীকৃত সংজ্ঞা দেয়াটা জটিল। তা ছাড়াও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্রম এর ধারণারও পরিবর্তনের হয়েছে।

দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীদের তাল মিলিয়ে শিক্ষণ যোগ্যতা অর্জন করার লক্ষ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ খিষ্টাব্দে সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে নতুন কারিকুলাম। এই নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রচেষ্টা হয়েছে। যেটি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষামূলকভাবে ৬২টি বিদ্যালয়ে শুরু করার কথা ছিলো। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে থেকে সারা দেশে (এনসিটি বি)-র কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হবে। এ বছর (২০২৩) প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। আগামী বছর (২০২৪) এ দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে, ২০২৫ থ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ এবং ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বাদশ হয়ে পুরো শ্রেণি পর্যায় সম্পন্ন হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম ২০২৩ এ বই থেকে শুরু করে, শিখন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ সকল কিছুতে থাকছে আমূল পরিবর্তন। এই পাঠ্যক্রম বা শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে মাথায় রাখা হয়েছে বিশ্বের পরিবর্তনের গতি, জীবনমুখী শিক্ষার বিষয়, শিক্ষার্থীর মানুষিক বিকাশ ও আনন্দঘন পাঠ প্রদান করা।

আমরা সাধারণত বলে থাকি, শেখার কোনো বয়স নাই, শেখার কোনো শেষ নাই। আমরা সবাই শিখি, কিন্তু কেউ শিখে সবার ওপরে উঠে যায়, আর কেউ শিখে নিজেকে শেষ করে দেয়। পার্থক্য শুধু এটুকু। আমরা একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করি, একটা পরিবেশে বেড়ে উঠি, একটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেকে মানসম্মত ও যুগোপযোগী করে নিজেকে শপে দেই নিজের কর্ম সম্পাদনে। শেখা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। শিখছি নিজের কর্মস্থলে। সময় ফুরালো। এবার ফিরতে হবে আবার সেই চিরচেনা আমাদের সাধের, স্নেহের সংসারে। শেখা কিন্তু আমাদের থেমে নেই, আমরা শিখেই চলেছি। আমরা শিখছি কিন্তু পার্থক্য শুধু সময় আর বয়সের।

শিক্ষাক্রম-২০২৩ এ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা নামে একটা বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। নিয়মিত পরিক্রমায় চলছে পাঠদান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে জীবন ও জীবিকার পাঠদান কৌশল বিভিন্নভাবে আলোচনা ও সমালোচনার কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান। তার বিচার হবে, বিচার তার হতেই হবে!

জীবন ও জীবিকা বইয়ের মুল বিষয়বস্তু, দৈনন্দিন জীবনবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও সর্বশেষ মুল্যবোধ। কথাটা যদি ভুল না হয় তাহলে হয়তো ঠিক আছে। আমাদের কোমলমতি শিশুরা এগুলো শিখবে তাতো হতে পারে না। এগুলো তো আমরা বাড়িতে শেখাতে পারি, এর জন্য তো আর ঘটা করে শেখানোর প্রয়োজন নেই। সত্যি কি এগুলো পরিচ্ছন্ন, সুন্দর করে শেখার দরকার নেই?

কিছুদিন আগে ঢাকার এক নামকরা স্কুলে জজ সাহেবের মেয়েকে শ্রেণি শৃঙ্খলা মেনে রুম ঝাডু দিতে বলা, তা নিয়ে তো কম আলোচনা হলো না। জজ সাহেব আসলেন, শিশুদের সঙ্গে তাদের অভিভাবদের কটূক্তি কম করেননি, কিন্তু ফলাফল কি হলো আমাদের মুল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হলো। প্রশ্নবিদ্ধ হলো নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধ। কিন্তু তিনি তা না করে যদি উনার মেয়ে যে শ্রেণিতে পড়েন সে শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে নিয়ে মুল্যবোধ বিষয়ে একটা সেশন পরিচালনা করতেন, সেশনের ফাঁকে মেয়ের অপারগতা ও মেয়ের জীবনে তার ভূমিকা আলোচনা করতেন, তাহলে আজ মেয়েকে নিয়ে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না। বরং সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তো বৈ কমতো না। আমার প্রশ্ন সেও তো এই সমাজের, পরিবার তাকে কী শেখালো। আমরা তার থেকে কী শিখলাম, সমাজ কী দেখলো। এ দায় কার?

সমসাময়িক সময়ে আরো একটা বিষয় নেট দুনিয়ায় আলোচনা হয়েছে, পরীক্ষার হলে অসুদপায় অবলম্বন করতে না দেয়ার কারণে শিক্ষার্থী শিক্ষকের গালে চপেটাঘাত করছেন! হায়রে সেলুকাস! বিচিত্র পৃথিবী তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে!

একটা সময়ে প্রত্যেক গ্রামে পাঠশালা বলে একটা স্কুল ছিলো। বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়তেন। একজন শিক্ষক তার মতো করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাদান করতেন। একটা বাড়িতে উনি থাকতেন। সন্ধ্যা হলে শিক্ষার্থীদের পরের দিনের পড়া গুলো পড়াতেন। স্কুলের নিয়ম মেনে পাঠশালায় সাময়িক পরীক্ষা হতো, শিক্ষার্থীরা প্রমোশন পেয়ে ওপরের শ্রেণিতে উঠতেন। সেখানে নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধ শেখানো হতো। সমাজের সুবিধাভোগী কিছু মানুষের কল্যাণে কিন্ডারগার্টেনের কাছে ভালোবাসার, সাধের পাঠশালা বিলীন হয়ে গেছে। কিন্ডারগার্টেন ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট ব্যবসা চলছে। সপ্তাহে বা মাসে পরীক্ষার গাদা গাদা বই কেনার চল তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীর কোনো ফুসরত ফেলার সময় নেই। তারচেয়েও সমস্যা যেনো মায়েদের। অবৈধ প্রতিযোগিতার শিকার হচ্ছেন কোমলমতি শিশুরা। এখানেও মুল্যবোধের চর্চা হয় না।

প্রায় সকল বিদ্যালয়ের সভাপতি হন যারা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পান এমন ব্যাক্তিরা। তারা শিক্ষাঙ্গনের ধারেকাছেও আসেন না। সুযোগ নেই। পারলেও ওপরের শ্রেণিতে, না পারলেও ওপরের শ্রেণিতে। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। আমি জিপিএ (৫) পেয়েছি, ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না! ভালো শিক্ষার্থী! এর ধারেকাছেও মুল্যবোধের বাণী পৌঁছাবে না। ওরা থাকে ওধারে! সত্যি যদি নীতি-নৈতিকতার চর্চা হয় তাহলে শিক্ষক কেনো শিক্ষার্থীর কাছে অপমানিত হবেন!

দিন দুয়েক আগে একটা শিক্ষা কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পরে আমি আবিষ্কার করলাম নুরুন্নবিকে। বয়স তার ১১ বছর। ৫ম শ্রেণিতে পড়েন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার বাবার ঝালমুড়ি বিক্রির জন্য একটা ভ্যান আছে। কথার ফাঁকে তার এক সহপাঠী বললেন, তিনিও ভালো ঝালমুড়ি বানাতে পারেন। জিজ্ঞাসা করতে তিনি যা বললেন আমি তো অবাক। তিনি নিয়মিত স্কুলে যান কিন্তু বাবাকে সাহায্যও করেন। বসনে চাকচিক্য না থাকলেও তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করেন। অন্য সহপাঠীরা বললেন, তিনি লেখাপড়ায়ও ভালো।

আমার প্রশ্ন নুরুন্নবি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। তিনি কোথা থেকে শিখলেন বাবাকে সাহায্য করতে হবে। বাবাকে সাহায্য করার এ মানসিকতা কোথা থেকে জন্ম নিলো। নুরুন্নবির মুল্যবোধ চর্চা কোথায় হয়? নুরুন্নবিরা অনেক দুর এগিয়ে যাবেন। অর্থনেতিক ভাবে নুরুন্নবি’রা হয়তো পিছিয়ে কিন্তু নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধ এ সবার ওপরে থাকবে। জয়তু নুরুন্নবি!

নীতি-নৈতিকতা, মুল্যবোধ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা ও কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে আনার জন্যই ‍আমাদের জীবন ও জীবিকা পাঠ। তাই ষষ্ঠ থেকে দশম, সকল শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয় অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি।

লেখক: গুরুদাস ঢালী, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার টেকনিক্যাল অফিসার

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039539337158203