শিক্ষা নিয়ে ভাবনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্নকেন্দ্রিক। অনেক সুদূরপ্রসারী ভাবনা ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্টদের স্বার্থে আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি। জাতির জনক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি।
বিশেষ করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ে তোলার পূর্বশর্তই হলো শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করাই হলো গণমুখী শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাতিকে এক অনন্য সংবিধান উপহার দিয়েছেন। এ সংবিধানে শিক্ষাকে গণমুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথম যে বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ ছিলো।
বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে যুগান্তকারী এ শিক্ষা কমিশনের যাত্রার সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, শিক্ষার নানাবিধ অভাব ত্রুটি বিচ্যুতি দূরীকরণ, জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশে এ কমিশন।
একই ধারাবাহিকতার আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয়েছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি শিক্ষা কমিশন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ফলে আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি কুদরত-এ খুদা শিক্ষা কমিশন। পরবর্তীকালে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা কমিশন ১ম দিকে খানিকটা তৎপর থাকলেও, পরবর্তী সময় হতে অদ্যাবধি তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দুটি শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক স্তর রাখা হয়েছে ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি, মাধ্যমিক স্তর রাখা হয়েছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি, উচ্চ স্তর হলো স্নাতক বা সম্মান ও মাস্টার্স ডিগ্রি। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রর্বতন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের আমলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস হয়েছিলো। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষানীতি প্রাথমিক স্তরের ৭৬৩টি বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে ক্লান্ত হয়ে একেবারে যেনো চির নিদ্রায় শায়িত হয়ে পড়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়।
৭৬৩টি বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত খুলেও যেনো তারা ভুল করেছেন। বিদ্যালয়গুলোর ৬ষ্ঠ-৮ম পরিচালনার দেখভালসহ আর্থিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের যেনো কোনো দায় নেই। দেখভালহীন প্রাথমিকের ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণি যেনো এতিমের মতো চলছে দুঃখ কষ্ট করে। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ ও সুবিধা সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার প্রধান উদ্দেশ্য, এদেশের তৃণমূলের সাধারণ মানুষের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা। অথচ গরিব সাধারণ মানুষের ৮ম শ্রেণির পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময়ে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়কে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছিলো। কয়েকমাস অপেক্ষা করে প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়ের নীরবতা ও অপারগতার ফল, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বাধ্য হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণলায়কে যথারীতি পূর্বের ন্যায় নিতে হয়েছিলো। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রাথমিকের প্রধান চ্যালেঞ্জ, কেবলমাত্র তৃণমূলের কর্মকর্তাসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শিশু শিক্ষা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের শূন্যতা। তারা মূল্যায়ন তথা পরীক্ষা নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে গুলিয়ে ফেলেছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মূল্যায়নের নামে ২য় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ১ম, ২য় ও ৩য় প্রান্তিক পরীক্ষা নেয়া হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে একটা বাস্তব ঘটনার বর্ণনা করছি, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, আমাদের অঞ্চলের একজন লেখাপড়া জানা বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা পানিকে হানি কেনো বলো? বন্ধু প্রতিবাদ স্বরূপ উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ‘আমরা হানিরে হানিই কই, আপনারা হানি শুনতে হানি শুনেন।’
মূল্যায়ন সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্য আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ছুটির তালিকায় ১ম, ২য়, ও ৩য় প্রান্তিক মূল্যায়ন নেয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাক-প্রাথমিক ও ১ম শ্রেণির ধারাবাহিক মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিলো। কেবলমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষকসহ কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণসহ ধারাবাহিক মূল্যায়নের জ্ঞান না থাকায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হয়নি। পরীক্ষা ব্যবস্থা হলো শিক্ষার আদি পরিমাপক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রশ্নকর্তা নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্য থেকে কতিপয় প্রশ্ন করে থাকেন। শিক্ষার্থী প্রশ্নগুলোর উত্তর যথাযথ জানা থাকলে পরীক্ষায় ভালো ফল বা কৃতিত্ব অর্জন করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিমাণ ব্যাপক থাকলেও, যথাযথ প্রশ্নের বাহিরে থেকে আসলে তাকে অকৃতকার্য হতে হয়। পরীক্ষার এ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি লোপ পায়। এ মানসিক শক্তি লোপ পেয়ে লেখাপড়া থেকে চিরবিদায় নিতে হয় । পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন হলো সর্বোৎকৃষ্ট পরীক্ষা। প্রতি পিরিয়ড, প্রতি পাঠ, প্রতি অধ্যায়, প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাসে শিক্ষার্থীর পাঠের বলা ও লেখার যোগ্যতা অর্জন করিয়ে নতুন পাঠের দিকে অগ্রসর করাতে হবে। কোনো অবস্থায় শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি রেখে, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সামনে এগিয়ে যাওয়া কাম্য হতে পারে না। মূল্যায়ন ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীর বাহ্যিক আচরণিক পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন শিক্ষক শিক্ষার্থীর নিয়মিত ও সময়মতো বিদ্যালয়ে আগমন-প্রস্থান। নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে হলে শিক্ষককে ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিতে আগমন, প্রস্থান করতে হবে। শিক্ষককে সময়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে কর্ম সম্পাদন করতে হবে। একমাত্র শিক্ষকরাই পারেন আগামী প্রজন্মকে সময়নিষ্ঠ করে গড়ে তুলতে। নিদিষ্টস্থানে ময়লা আবর্জনা ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
টয়লেট ব্যবহার, সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে। এজন্য বিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ২ টুকরা সাবান স্কুল ব্যাগে রাখার অভ্যাস করাতে হবে। যাতে শৌচকর্মের পর একটুকরা ব্যবহার করবে, আরেক টুকরা হাত, মুখ ধোয়ার কাজে ব্যবহার করবে। কোনো শিক্ষার্থী অন্যায় করার পর, সত্য কথা বললে, তাকে তিরস্কার না করে, অন্যায় না করার জন্য নিরুৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি সত্য কথা বলার জন্য প্রশংসা বা পুরস্কার দিতে হবে। বিদ্যালয়ে সকল সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যায়ন বিবরণীতে এ সকল বিষয়ে তাদের প্রশংসা করে শিক্ষার্থীর মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব তুঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। বিদ্যালয়ে নিয়মিত খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষককে নিতে হবে। এ জন্য বিদ্যালয়ে প্রতিদিন ৪ পিরিয়ডের বেশি হওয়া কাম্য নয়। প্রতিটি পিরিয়ড হবে ১ ঘণ্টা। শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বাগান করাসহ পরিচর্যা কাজে নিয়োজিত করা, বিদ্যালয়ের সম্পদের প্রতি যত্ন নেয়া, খুঁটিনাটি মেরামত কাজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা বাংলাদেশের বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন, সরকারি-বেসরকারি হাইস্কুলের প্রাথমিক শাখার জন্য বাধ্যতামূলক চালু করতে হবে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পদোন্নতি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ডিপি-ই এড ট্রেনিং প্রাথমিকের সকল কর্মকর্তাদের সমাপ্ত করে মাঠ পর্যায়ে তদারকি করতে দেয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলে ধারাবাহিক মূল্যায়নসহ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সমৃদ্ধ হবে। অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদন ব্যতিরেকে, উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের কার্যক্রম অবৈধভাবে চালিয়ে আসছে। তারা আশেপাশের অনুমোদিত মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ও পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। সংক্ষিপ্ত সময় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়, সকল শিক্ষার্থীর মাঠে অংশগ্রহণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে দলীয় কাজে সকল শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণ করানো জরুরি।
রাষ্ট্র গড়ার প্রধান কারিগর শিক্ষক। এ বাক্যটি রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ সমাজসহ সংশ্লিষ্টদের মনেপ্রাণে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অথচ উপলব্ধির পরিবর্তে, তারা শিক্ষকদের এড়িয়ে চলেন। নতুন শিক্ষাক্রমে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। তা দূর করা প্রয়োজন। বর্তমান শিক্ষাক্রম যেখানে সৃজনশীল বিষয় আছে, পরীক্ষার চাপ কম, মুখস্থ না করে ভালোভাবে বোঝার সুযোগ আছে। এ ছাড়াও এই শিক্ষাক্রম নোট, গাইড ও কোচিং মুক্ত। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজ ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকটা আর্থিক সক্ষমতা আছে। বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের আর্থিক সক্ষমতা নিয়ে হৃদয়বিদারক কাহিনি উপস্থাপন করলে জাতি হিসেবে আমাদের হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। সরকারি হাইস্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধার সঙ্গে তুলনা করলে একটা প্রবাদ মনের মাঝে ভেসে উঠে। প্রবাদটি হলো-‘কোথায় রাজরানী কোথায় চাকরানী’। সে হতভাগা শিক্ষকদের প্রধান কাজ শিক্ষার্থীদের জীবন-জীবিকা উপযোগী সুশিক্ষা, বিদ্যালয়ে প্রদান করা। বিদ্যালয়ে সময় স্বল্পতা, শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি, শিক্ষক স্বল্পতা, বিরতিহীন ক্লাস, নিজ পরিবারের জীবন-জীবিকার চিন্তা মাথার মাঝে ঘুরপাক খাওয়ায়, শিক্ষকের আন্তরিক মনমানসিকতা কতোটা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সফলতা আনতে পারে? শিক্ষাক্রমে কোচিং ও টিউশনি অনেকটা মহাপাপ।
একজন আর্থিক সচ্ছলতাহীন শিক্ষককে এ কর্ম ছাড়া অন্য কর্ম করা কতোটুকু যৌক্তিক? করোনায় বেতন বন্ধ থাকায়, একজন শিক্ষকের ফুটপাতে কলা বিক্রির ঘটনা দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় তুলেছে। এ নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও সংশ্লিষ্টদের কতজনের ভাবনা উদয় হলো? শিক্ষকদের পরিবার অনাহার, অপুষ্টি, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও কারো যেনো দায় নেই। দায় দেখার আছে শিক্ষকের টিউশনি, কোচিং করার অপরাধের। আজকাল শিক্ষিত, মেধাবীরা এনটিআরসি’র মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় এসে থাকেন। ভালো বেতনের পেশা পেলে তারা শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যান। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রবাদ মনে এলো ‘যার নেই কোনো গতি, সে করে পণ্ডিতি’ বর্তমান শিক্ষাক্রম প্রশিক্ষণ ভালোভাবে জানা, প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন চৌকষ মেধাবী শিক্ষক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে সে পর্যায়ের কতোজন শিক্ষক রয়েছেন? মেধাবী, চৌকষ শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবে সে মানসিকতা সংশ্লিষ্টদের মাঝে দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনার মতো সকলের মাঝে এ ভাবনা থাকতে হবে।
শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে শিক্ষক সমাজকে অবহেলা করে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে। এ প্রেক্ষাপটে সর্বাগ্রে শিক্ষকদের মর্যাদা, আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ণ, বৈষম্য দূরীকরণসহ শিক্ষার সমস্যাকে রাষ্ট্রের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন।
শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতিপয় সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ১. প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাদরাসা, হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মর্যাদা অভিন্ন প্রথম শ্রেণির হওয়া প্রয়োজন। ২. তারা সরকারি, সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রে ১ম শ্রেণির সম্মান ও সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির অধিকারী হিসেবে গণ্য হবেন। ৩. দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী, চৌকষদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এজন্য বেতন কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তর শিক্ষকতা পেশায় দেয়া প্রয়োজন। ৪. শিক্ষকরা দেশ ও জাতির সম্মানিত ব্যক্তি।
এ জন্য কোনো বহিরাগত কর্মকর্তার অধীনে তাদের ন্যস্ত করা সমীচীন নয়। শিক্ষকতা পেশা থেকে পদোন্নতি দিয়ে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাদের কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। ৫. শিক্ষকদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে সাময়িক কর্মচ্যুতির আদেশ প্রদান অনুচিত। অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকতার মহান পেশায় অপরাধ না করেও মর্যাদা হানি হয়ে থাকে।
রাষ্ট্র গড়ার কর্ণধার হলেন শিক্ষক সমাজ। তাদের আর্থিক, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অবহেলায় রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন হবে মহা চ্যালেঞ্জের। সবার ওপরে শিক্ষক। আমরা সবাই তাদের গড়া। জয় হোক শিক্ষক সমাজের।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ