শিক্ষাক্রম বিস্তরণে শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

জুলফিকার বকুল |

জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অষ্টম ও নবম শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এ বছর থেকে। ইতোমধ্যে সারা দেশব্যাপী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শেষ হয়েছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিকভাবে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় ছিলো।

শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের দিক বিবেচনায় এনে বছরজুড়েই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। অবশ্য শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন যেনো ব্যাহত না হয়, সে কারণে প্রতিটি অভিজ্ঞতা পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্মানিত শিক্ষকদের একটি কাঠামোতে আবদ্ধ করা হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য দেয়া হয়েছে টিচার্স গাইড। যেহেতু বৈষম্য দূর করে সমতা আনয়ন এ শিক্ষাক্রমের একটি উদ্দেশ্য। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক গাইড অনুসরণ করা শিক্ষকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে শিক্ষকরা নির্ধারিত নির্দেশনার মধ্য থেকে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীনও হতে হয়েছে শিক্ষকদের। 

শিক্ষক প্রশিক্ষণে উঠে এসেছে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ। অধিক শিক্ষার্থী, অনুকূল শ্রেণিকক্ষ না থাকা, শ্রেণিকক্ষের বাইরের কার্যক্রমে কিছু কিছু অভিভাবকের অসম্মতি, মূল্যায়ন বিতর্ক ইত্যাদি সমস্যার সমাধান শিক্ষককে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে করতে হয়েছে। এ শিক্ষা কার্যক্রম যেহেতু শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক, তাই শিক্ষককে থাকতে হয় একজন মডারেটর বা রিসোর্স পারসন হিসেবে। কাজেই লেকচার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষককেও অনুশীলন করতে হয়েছে।

ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার্থীর মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসহ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রতি সচেতনতার উন্মেষ ঘটানো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও যুগের পরিবর্তনে আধুনিক সভ্যতায় তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বে শিক্ষাকে শুধু জ্ঞান নির্ভর না করে প্রয়োগ ও উৎপাদন সহায়কমূখী করাটা একান্ত জরুরি।

প্রয়োজন এখন বিশ্বায়নে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা। বৈজ্ঞানিক বিশ্বে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবে প্রতিফলন প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর মেধার পূর্ণবিকাশ সাধনের প্রচেষ্টা তার কর্মজীবনে সফলতা এনে দেয়। আর মেধা বিকাশের জন্য প্রয়োজন অনুকূল ক্ষেত্র এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানার্জন। যা বর্তমান শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখন বিস্তরণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাটা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়।

একটি শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মূল্যায়নের বিষয়টি আগে বিবেচনায় আনতে হয়। কারণ, জ্ঞান পরিমাপের কোনো একক নেই। পূর্বের শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ হলেও বর্তমানে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষার্থী প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকে কতোটুকু দক্ষতা অর্জন করবে তা ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়িত হবে। অর্থাৎ শিক্ষা অর্জিত হবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং মূল্যায়িত হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে। কাজেই মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি অনেকটাই জটিল। যেখানে শিক্ষককে হতে হবে দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও আন্তরিক। পুরোটা অভিজ্ঞতা জুড়েই শিক্ষককে পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বন্ধুসুলভ সহায়তার মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা এবং যথাযথ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন সম্পন্ন করা শিক্ষকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

একটি অভিজ্ঞতা শেষ করতে শিখন চক্রের চারটি ধাপ শিক্ষার্থীকে অতিক্রম করতে হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা/প্রেক্ষাপট, প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণ, বিমূর্ত ধারণায়ন এবং সক্রিয় পরীক্ষণ। প্রতিটি ধাপে শিক্ষার্থীকে কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে হবে। কাজেই মূল্যায়ন বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনুধাবনীয়। সর্বজনীন বিবেচনায়, একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মানসম্পন্ন শিক্ষকগোষ্ঠী গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত নেয়া এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকের হাত ধরেই বর্তমান শিক্ষাক্রম আলোর মুখ দেখবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে সমন্বয় ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক কেউই এখন কেবল শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ নয়। 

শিক্ষার্থীর জীবনকে নান্দনিক, আনন্দময় ও অর্থবহ করে কর্ম জীবনে যোগ্য করে গড়ে তুলতে মানবিক মূল্যবোধে সৃষ্টিশীল চেতনা জাগ্রত করার দায়িত্ব যখন শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত তখন শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিকে স্বতঃস্ফূর্ততা ও মানুষ গড়ার প্রবনতা স্থায়ী ও সুনিশ্চিত হওয়াটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন শিক্ষাক্রম ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে জাতিসত্তার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখবে এমনটি প্রত্যাশা করছি।

লেখক: মাস্টার ট্রেইনার ও শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025050640106201