দৈনিকশিক্ষাডটকম ডেস্ক : হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ.) ছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষক, শিক্ষা সংস্কারক, শিক্ষা প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সাধক। তিনি পূর্ব বাংলার খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে বেশির ভাগ লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। কলকাতার লন্ডন মিশন সোসাইটি স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি চাকরি জীবন শুরু করেন পূর্ব বাংলায় রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে সুপার নিমারারি টিচার হিসেবে। তারপর তিনি পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তে শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে অ্যাসিসট্যান্ট ডিপিআই এবং ডিপিআই হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বেশির ভাগ কাজ করেছেন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এলাকায়। এ সময় তিনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কত স্কুল যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সেটা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। কলেজ গড়ার ক্ষেত্রেও তার অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ গড়ার সময়ে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এই কলেজেই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়াশোনা করেছেন। এই কলেজের বেকার হোস্টেলটিও গড়ার জন্য তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এবং সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়। বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) খবরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন ড. আতিউর রহমান।
নিবন্ধে আরো জানা যায়, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার লক্ষ্যে যে নাথান কমিশন তৈরি হয়েছিল তার একটি সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রহ.)। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তৈরির জন্য ৯ সদস্যের যে কমিটি করেছিল সেই কমিটিরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছেন। এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি সিনেট সদস্য ছিলেন। সেই সময়টায় পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতি অনেক অনগ্রসর ছিল। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা ছিল প্রকট। এবং এই সময়টি তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলায় সত্যি সত্যি যদি উন্নয়ন করতে হয়, যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয় তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এজন্য পূর্ব বাংলায় অসংখ্য মাদরাসা, স্কুল ও কলেজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি অনেকগুলো আমূল সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন- একসময় আইএ, বিএ ও এমএ সব পরীক্ষায় আগে নাম লেখা হতো। নাম লেখা থাকলে হিন্দু ও মুসলিম বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ ছিল। সুতরাং, তিনি প্রস্তাব করলেন পরীক্ষার খাতায় নাম থাকবে না। শুধু রোল নম্বর থাকবে এবং এই সংস্কারটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত গড়ে তোলার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল তখন এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ নিরসনের জন্য ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। আরও ছিলেন নওয়াব আলী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও স্যার সলিমুল্লাহ। তাদের সঙ্গে মিলে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমাত্রিক কাজ করেছেন। আর আমরা তো জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীকালে আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সুতরাং, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি শুধু শিক্ষাসংস্কারক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না। ছিলেন তিনি একজন ভালো লেখকও। অসংখ্য বই তিনি লিখেছেন এবং অন্যের অসংখ্য বইও প্রকাশ করেছেন তার প্রকাশনী থেকে। তিনি মখদুমী লাইব্রেরিটি স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি তার আহ্ছানউল্লা বুক হাউস লিমিটেড থেকে আমাদের দেশের অসংখ্য বিখ্যাত উপন্যাস যেমন আনোয়ারা, বিষাদ সিন্ধু, কাজী নজরুল ইসলামের জুলফিকার, বনগীতি, কাব্যে আমপারা; আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিত্যক্ত স্বামী তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এসব বই প্রকাশ করে তিনি এই পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মানস গঠনে ও মুসলিম সাহিত্য চর্চায় আধুনিকতা এবং সমাজলগ্নতা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
এই সময়টায় তিনি তার সুখ্যাত প্রতিষ্ঠান আহ্ছানিয়া মিশন তার নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার নলতায় শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমরা সবাই জানি প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ। একলা মানুষ টুকরা মাত্র। কিন্তু অনেকে মিলে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি উন্নয়ন করা যায়। সেই বিচারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখনো তা করে যাচ্ছে।
আমি গভর্নর হিসেবে যখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সঙ্গে জড়িত ছিলাম তখন দেখেছি আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। আমার জানা মতে, খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খুবই গুরুত্ব দিয়ে এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য তার নিজের পূবালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংককে উৎসাহিত করেছেন। এ ছাড়া আহ্ছানিয়া মিশন সমাজের নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাজ করছে। সুতরাং, এই শিক্ষাবিদ ও সংস্কারক খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মনে গেথে আছেন। সে জন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন। বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মরণোত্তর পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার অর্জন করে।
তাই তাকে বরাবরই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি সেই সব জায়গায় কাজ করেছেন যেখানে কাজ করলে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলা যায়। শিক্ষাই মানুষের মন ও মননের পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা ও জীবন আলাদা হতে পারে না। সে কারণেই একটি মানবিক ও অর্থনীতি-সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য তিনি সব সময় কাজ করেছেন শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষার প্রসারে তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য তিনি নিরলস কাজ করেছেন। এই কারণে আমাদের এই পূর্ব বাংলায় তার যারা উত্তরসূরি তারা এখনো তাকে স্মরণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য এবং সংস্কারের জন্য।
আমি জেনে খুব আনন্দিত যে, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডিসেম্বর মাসব্যাপী খানবাহাদুর আহ্ছানুল্লাহর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। এই জন্মবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে তার অবদানগুলো সবার সামনে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই আমরা তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন ও তাদের মনে তার ভাবনাগুলো গেথে দিতে পারি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর (রহ.) নৈতিকতাকে আমাদের সমাজ এবং শিক্ষায় আরও বেশি প্রতিফলিত করে তুলতে পারলে এটি হবে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বড় উপায়। কেননা শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নীতিবান ভালো মানুষ গড়ে তোলা। আজীবন তিনি সেই কাজটিই করেছেন। আমরাও যেন তার কাছ থেকে এই শিক্ষাটিই গ্রহণ করতে পারি।
লেখক: ড. আতিউর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক