গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারে পতনের পরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি ভেঙে দিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ডিসি-ইউএনওদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডিগ্রি স্তরের শত শত কলেজেও বাদ পড়ে যায় পতিত সরকারের আমলে গড়া কমিটি। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, অ্যাডহক কমিটির জন্য কলেজ পরিদর্শক বরাবর কমিটির সভাপতি ডিসি বা ইউএনও এবং অধ্যক্ষের স্বাক্ষরিত নামের তালিকা পাঠাতে হবে। সেই নামের তালিকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অনুমোদন দিয়ে কমিটি চূড়ান্ত করবেন।
তারই ধারাবাহিকতায় দেশের নানা প্রান্তের কলেজে অধ্যক্ষদের প্রস্তাব করা নামের বাইরে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বিশেষ সুপারিশে ইচ্ছেমতো কমিটি অনুমোদন দিচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ ও কলেজ পরিদর্শক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। স্থানীয় শিক্ষানুরাগীরাও বিব্রতবোধ করছেন এমন কর্মকাণ্ডে।
সম্প্রতি এসব সমস্যা নিয়ে সারা দেশ থেকে শত-শত কলেজ অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্টরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দপ্তরে আসছেন। যারা জোর তদবির বা গুরুত্বপূর্ণ কাউকে দিয়ে চাপ দিতে পারছেন প্রতিদিন শুধু তাদের প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনয়ন পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে।
কলেজ অধ্যক্ষরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শকের গত সেপ্টেম্বরে জারি করা নির্দেশনা মতো তিনজন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির শিক্ষা সনদসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দিয়ে প্যানেল দিয়ে সভাপতি ও পৃথক তিন সদস্যের প্যানেল দিয়ে বিদ্যোৎসাহী সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়ার জন্য কলেজের অফিশিয়াল ইমেইল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন করতে হবে। অধ্যক্ষরা সেটাই করছেন।
তবে দেশের এই দুই হাজার ডিগ্রি কলেজই স্থানীয়ভাবে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিরা উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন তাদের বাদ দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জারি করা নির্দেশনার অবমাননা করে শিক্ষার সঙ্গে সর্ম্পক নেই এমন লোকজন ডিগ্রি কলেজের সভাপতি হওয়ায় তারা শুরুতেই কলেজের অধ্যক্ষদের বিরুদ্ধে নিচ্ছেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাদের বিশেষ অবদান ছিলো এমন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত সময়ের মানুষ হয়েও এসব কমিটিতে স্থান না পাওয়া বিব্রত হচ্ছেন।
কলেজ অধ্যক্ষরাও তাদের পাঠানো স্থানীয় জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের বাদ দিয়ে যাকে তাকে ডিগ্রি কলেজের সভাপতি বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনয়ন দেয়ায় বিব্রত হচ্ছেন।
শিক্ষাবিদবরা মনে করেন এই সমস্যার সমাধান দ্রুত হওয়া উচিত। স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে অধ্যক্ষদের দেয়া আবেদন অনুযায়ী সভাপতি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনয়ন দেয়ার তাগিদ দেন তারা।
নাটোর জেলায় ৩২টি বেসরকারি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। এর প্রায় প্রতিটিতেই ঘটেছে এমন অনিয়ম। গায়ে জোরে অধ্যক্ষদের না জানিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও কলেজ পরিদর্শকের মাধ্যমে যাকে তাকে সভাপতি করে নিয়ে আসা হয়েছে। জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার পাঁচ ডিগ্রি কলেজের ৩টিতেই বিধি মোতাবেক অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয় নেই। উপজেলার রাজাপুর ডিগ্রি কলেজ, জোনাইল ডিগ্রি কলেজ ও খলিশাডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজে ৫ আগস্টের পরে কমিটি ভেঙে দিয়ে ইউএনওকে সভাপতি করা হয়।
একই সঙ্গে বিধি মোতাবেক সভাপতি ও অধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কলেজ পরিদর্শক বরাবরে নতুন করে অ্যাডহক কমিটি গঠনের জন্য আবেদন দেয়া হয়। কিন্তু তিন কলেজের কোনটিতেই আবেদনের প্রতিফলন ঘটেনি। তাদের পাঠানো তালিকা বাদ দিয়ে উল্টো কমিটি অনুমোদনের পরে অধ্যক্ষ এবং সভাপতিকে অবগত করা হয়েছে।
রাজাপুর ডিগ্রি কলেজের সভাপতি করা হয়েছে বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ব্যক্তিগত সহকারী মো. শামসুল আলম রনিকে। রনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই রাজাপুর কলেজের অধ্যক্ষকে ৩ মাসের ছুটিতে পাঠান।
একইভাবে দুলুর আরেক সহযোগী সাবেক ছাত্রনেতা মো. শহিদুল্লাহ সোহেল অধ্যক্ষের অজান্তেই সভাপতি হয়ে আসেন। তিনি এসেই অধ্যক্ষকে ৬ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন। একই উপজেলার খলিশাডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজে সভাপতি করা হয়েছে টিটু ইসলাম নামে এক যুবদল কর্মীকে। তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরনবিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের (ইআইআইএন নং -১২৮৩৬৪) ক্রিড়া শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তার এমপিও ইনডেক্স নম্বর- ১১৪৯৪৩০।
কলেজ তিনটি অধ্যক্ষ যথাক্রমে মোহাম্মদ তুগলক, আবুল আছর মো. শফিউজ্জামান ও আনম ফরিদুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। অধ্যক্ষরা বলেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট বিধান, কলেজের অফিশিয়াল ইমেইল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ইমেইলে আবেদন করতে হবে। সেই বিধান মেনেই সব কলেজের অধ্যক্ষ আবেদন করার পর কীভাবে প্রায় সব কলেজের অ্যাডহক কমিটিতে অধ্যক্ষদের দেয়া তালিকা বাদ দিয়ে যাকে তাকে মনোনয়ন দেয়া হলো। এসব নাম ভিসি কোথায় পেলেন? এই প্রশ্নের উত্তর অজানা।
এ সব বিষয়ে বড়াইগ্রামের উপজেলা নির্বাহী অফিসার লায়লা জান্নাতুল ফেরদৌস ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, রাজাপুর ও খলিশাডাঙ্গা কলেজ থেকে আমার স্বাক্ষর নেয়া হয়নি। অপরদিকে জোনাইল কলেজে আমি ও অধ্যক্ষ যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেটা বাদ দিয়ে নতুন ব্যক্তিদের নামে কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খলিশাডাঙ্গা কলেজের কমিটির বিষয়ে অধ্যক্ষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক বরাবর ওই কমিটি বাতিলের আবেদন এবং নতুনভাবে কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
একইভাবে জেলার বাগাতিপাড়ায় ৫টি ডিগ্রি কলেজে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি পদে অধ্যক্ষের আবেদনে জামনগর ডিগ্রি কলেজের সানাউল্লা, বাগাতিপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজে সুভাষ গারোদিয়া, সাইলকোনা ডিগ্রি কলেজে আব্দুল ওয়াহাব, তমালতলা কৃষি ও কারিগরি ডিগ্রি কলেজে হানিফুর রহমানকে মনোনয়ন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পরে এদের মধ্যে তিনজন বাগাতিপাড়া পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা শরিফুল ইসলাম লেলিনের সুপারিশের অধ্যক্ষদের পাঠানো তালিকা থেকে মনোনীত হয়েছেন। পরবর্তীতে এই আসনের সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলের সুপারিশে সবগুলো নাম পরিবর্তন করে নতুন ভাবে যথাক্রমে মাহতাব আলী, মুক্তার হোসেন, নজরুল ইসলাম ও হাফিজুর রহমানকে সভাপতি মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে হাফিজুর রহমান নামে একজনকে ডিগ্রি পাস নয় অভিযোগ করে তার নাম পরিবর্তনের জন্য আবারো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এসব কলেজের অধ্যক্ষরা বলেছেন প্রথম আবেদনের পর নাম পরিবর্তনের জন্য তারা কোনো আবেদন না করলেও সব কলেজের সভাপতি ও বেশিরভাগ বিদ্যোসাহী সদস্যের নাম পরিবর্তন হয়ে তাদের কাছে নির্দেশনা চলে আসছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাটোরের একাধিক ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন, নিয়ম লংঘন করে ভিসি যেভাবে সভাপতি ও বিদ্যোসাহী সদস্য মনোনয়ন দিচ্ছেন এসব পরিবর্তন করে তাদের দেয়া প্যানেল থেকে মনোনয়ন না দিলে তারা দ্রুত উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন।
এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকারের ফোন নম্বরে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহর ফোন নম্বরে কল দিলে তিনিও রিসিভ করেননি। তবে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলে তিনি বলেন, কলেজের নাম দেন চেক করে ব্যবস্থা নেবো।
অভিযোগ রয়েছে, ভিসির দুইজন সহকারী রয়েছেন যাদের পঞ্চগড়ের এবং অপরজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ছাত্রদলের সভাপতি। তারাই মূলত অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা ও অধ্যক্ষদের আবেদন পাশ কাটিয়ে যাকে তাকে মনোনয়ন দিচ্ছেন।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।