দেশের অন্য যে কোনো সম্পদের চেয়ে মানবসম্পদকে সবচেয়ে মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়। অতি মূল্যবান এ সম্পদটি উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা। কারণ দেশ ও জাতিকে বিশ্বে আসীন করার জন্য শিক্ষা ও এর প্রয়োগ অন্যতম একটি মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশের এই বৃহত্ সম্পদটি হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যে বিতর্কে সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যার যার অবস্থান থেকে অংশ নিচ্ছে। তার মধ্যে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদরা যেমন আছেন, তেমনি আছে আজকের ভুক্তভোগী তরুণ সমাজ, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। করোনার প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘ ১৫ মাস যাবত্ স্থগিত হয়ে আছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। মহামারি, নতুন সিদ্ধান্ত ও শিক্ষাব্যবস্থায় নাজেহাল শিশু থেকে স্নাতকোত্তর প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী। কিছুদিন পরপর এক-একটি সিদ্ধান্ত যেন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে কতিপয় শিক্ষার্থীর। ইতিমধ্যে অনেকের শিক্ষাজীবনের ইতি টানার মাধ্যমে এই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটেছে; আবার জীবন নিয়ে অনেকের স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। এই মহামারি অনেক শিক্ষার্থীর কেড়ে নিয়েছে শিক্ষার মতো একটি অন্যতম মৌলিক অধিকার। সোমবার (৭ জুন) ইতে্তফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়,করোনার দীর্ঘ বন্ধে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জীবনের নানা ধরনের ছন্দপতন ঘটেছে। পড়াশোনার এই দীর্ঘ বিরতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে গিয়ে রাস্তায় কাজের সন্ধানে নেমে পড়েছে অনেক শিশু। কাজে লেগে পড়া অধিকাংশ শিশু যন্ত্রপাতি ছেড়ে পড়ার টেবিলে ফিরতে পারবে কি না, এ ব্যাপারে সন্দিহান সকলেই। ইউনিসেফ এক নতুন প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ সংকটের ফলে লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা গত ২০ বছরের অগ্রগতির পর শিশু শ্রম বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে যারা চাকরির প্রত্যাশায় একটি সার্টিফিকেটের অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন তাদের আশা আজ হতাশায় পরিণত হয়েছে, যা তাদের মানসিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক চাপের মুখে ফেলেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এতে অনেক পরিবার বাল্যবিবাহের মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ফলে আগামীর নারী প্রজন্ম হেরে যাচ্ছে নিয়তির কাছে। সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহে হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যত্ নিয়ে দুশ্চিন্তা ও দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।
আরেক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অলস সময় ও ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তাদের মধ্যে হতাশা ও অনিশ্চয়তা বাসা বেঁধেছে। যে অসুখ করোনার চেয়েও পেয়ে বসেছে তাদের। এছাড়া বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট নির্ভরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে, যা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও শহরে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা সচল থাকলেও গ্রামের দিকে এর ছিটেফোঁটাও নেই। অটোপাশ ও অনিশ্চিয়তায় শিক্ষার্থীদের বই ও পড়ার টেবিলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমতে শুরু করেছে। অটোপ্রমোশনের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনা ও ভালো ফলাফল করার মানসিকতা হারিয়ে যাচ্ছে।
সবকিছু মিলে বর্তমানে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। বাধ্য হয়ে তাদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি নিয়ে। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে হলেও শ্রেণিকক্ষে ফিরতে চাইছে অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু ছুটি বাড়িয়েই চলেছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। বিগত এক বছরে এখন পর্যন্ত শিক্ষা-সম্পর্কিত একটিও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত আসেনি। যেগুলো এসেছে, সবই সাময়িক সময় পর আর কাজে আসেনি। একের পর এক নতুন তারিখের বদলে শিক্ষার্থীরা কী চায় এবং কোন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের বিগত এক বছরের ঘাটতি পূরণ করা যায়, সেদিকে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটি পরিবারে শিক্ষার্থী ছাড়া বাকি প্রত্যেককে ঝুঁকি নিয়ে কাজে বের হতেই হয়।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
সুতরাং স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা মানে এই নয় যে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে আছে। আর যদি ভ্যাকসিনেশনের পরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত থাকত, তাহলে দেশে ভ্যাকসিন আসার পরপরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলে শিক্ষার্থীদের প্রতি। কারণ একটি দেশে যদি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাত থাকে, তাহলে তার অন্যতম একটি শিক্ষাব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী শুধু হতাশায় আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করেছে। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই সংখ্যা বাড়বে সুনিশ্চিত। সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করা এখন সময়ের শ্রেষ্ঠ দাবি। তাই কীভাবে এই প্রজন্মকে অন্ধকার থেকে আলোকিত করা যায় সেজন্য দেশের সুবিবেচকদের সঠিক নীতিমালা ও শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে গত এক বছরের ঘাটতি পূরণের জন্য বয়সসীমা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ এই বিপর্যয়ের জন্য একজন শিক্ষার্থীও দায়ী নয়। সেই সঙ্গে বাবা-মাদের সন্তানের প্রতি ধৈর্যশীল ও যত্নবান হতে হবে তাদের সন্তান যেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়। শিক্ষার্থীরা দেশের সম্পদ। তাই এই সম্পদ মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হবে সেটা কারোরই কাম্য নয়।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
লেখক : ফারহানা নওশিন তিতলী,শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।