শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে, হাইকোর্টে নীতিমালা

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত চূড়ান্ত নীতিমালার গেজেটের অনুলিপি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব (আইন) আবদুল জলিল মজুমদার অনুলিপি অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন। একাধিক সূত্র দৈনিক শিক্ষাডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

এ নীতিমালা অনুযায়ী-বুলিং-র‌্যাগিংয়ের মাত্রা অনুসারে দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। এর আগে ২৯ জুন চূড়ান্ত নীতিমালার গেজেট জারি করা হয়।

চূড়ান্ত নীতিমালায় বুলিং-র‌্যাগিংয়ের অপরাধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

মৌখিক বুলিং-র‌্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-কাউকে উদ্দেশ করে মানহানিকর বা অপমানজনক এমন কিছু বলা বা লেখা যা খারাপ কোনো কিছুর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে ইত্যাদিকে মৌখিক বুলিং বোঝাবে।

যেমন-উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন করা বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা, গালিগালাজ করা, হুমকি দেওয়া, শারীরিক অসমর্থতাকে নিয়ে উপহাস করা বা অনুরূপ কার্যাদি।

শারীরিক বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা, চড়-থাপ্পড়, শরীরে পানি বা রঙ ঢেলে দেওয়া, লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা মারা, থুথু দেওয়া, বেঁধে রাখা, কোনো বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে/বসে বা বিশেষ অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া অথবা কোনো কিছু করতে বা না করতে বাধ্য করা, কারও কোনো জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা, অশালীন বা অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা বা অনুরূপ কার্যাদি।

সামাজিক বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, পেশা, গায়ের রং, অঞ্চল বা জাত তুলে কোনো কথা বলা বা অনুরূপ কার্যাদি। সাইবার বুলিং-র‌্যাগিং সম্পর্কে বলা হয়েছে-কারও সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটু কিছু লেখা বা ছবি বা অশালীন ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করে তাকে অপদস্থ করা বা অনুরূপ কার্যাদি।

সেক্সুয়াল বুলিং ও র‌্যাগিং সম্পর্কে বলা হয়েছে-ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিজনকভাবে স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, ইঙ্গিতবাহী চিহ্ন প্রদর্শন করা, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা খুলতে বাধ্য করা বা অনুরূপ কার্যাদি।

এছাড়া এমন কর্ম, আচরণ, কার্যাদি যা অসম্মানজনক, অপমানজনক ও মানহানিকর এবং শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে, তা যে নামেই হোক না কেন তা বুলিং ও র‌্যাগিং হিসাবে গণ্য হবে।

চূড়ান্ত নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধে কমিটি গঠন এবং কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে-প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে ৩-৫ সদস্যবিশিষ্ট বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ এক বা একাধিক কমিটি গঠন করতে পারবে।

কমিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শিক্ষা বছরের শুরুতে কমিটি আবশ্যিকভাবে এবং পরবর্তীতে তিন মাস অন্তর শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা, মতবিনিময় সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‌্যাগিং হয় কিনা তা কমিটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে।

বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে-১. বুলিং ও র‌্যাগিংয়ে উৎসাহিত হয় এ রূপ কোনো কার্যকলাপ, সমাবেশ, অনুষ্ঠান করা যাবে না।

২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব জায়গায় বুলিং ও র‌্যাগিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব জায়গায় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করবে।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (আবাসিক হলসহ) কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের ঘটনার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে রিপোর্ট করবে, অন্যথায় নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী হবে।

৪. বুলিং ও র‌্যাগিং এর উদাহরণ এবং পরিণতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ ওয়েবসাইট এবং প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণা চালাবে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধ ‘দিবস’ পালন করে এ কুফল সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবে।

৫. সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবকদের শপথ নিতে হবে। কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বুলিং ও র‌্যাগিং করবে না, কাউকে বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের শিকার হতে দেখলে রিপোর্ট করবে, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন জানিয়ে তারা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করবেন।

৬. বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের কুফল সম্পর্কিত সিনেমা, কার্টুন, টিভি সিরিজ প্রদর্শন, অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণের ব্যাপারে অনলাইন বিহেভিওর সম্পর্কিত কর্মশালা ইত্যাদিসহ সহপাঠ্যক্রমিক কর্মশালা আয়োজনের জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৭. বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ’-এ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করবে। যেমন-শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে বিকশিত করা লক্ষ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, বই পড়ার প্রতিযোগিতা, দাবা খেলা, কেরাম খেলা ও বিভিন্ন খেলাধুলা আয়োজন করবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং সহানুভূতিশীলতার শিক্ষা দিতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিযুক্ত করতে হবে।

৭. শিক্ষার্থীরা বুলিং-র‌্যাগিংয়ের কুফল অথবা এর ফলে কীভাবে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে-সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য এবং সে সঙ্গে বুলিং ও র‌্যাগিং সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান তারা নিজেরাই বের করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শিক্ষক রোল প্ল্যানের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন।

৮. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কোনো শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের কাউন্সিলর হিসাবে অভিহিত করা হবে।

৯. বুলিং ও র‌্যাগিং নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। ১০. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত বুলিং ও র‌্যাগিং বিষয়ে পরীবিক্ষণ করবেন এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন।

প্রসঙ্গত, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার পর ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে ‘বুলিং’ ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির জন্য অতিরিক্ত শিক্ষাসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন আদালত।

নির্দেশ অনুযায়ী এই কমিটি একটি নীতিমালা খসড়া করে ২০১৯ সালে আদালতে দাখিল করে। এরপর নীতিমালা কয়েক দফা সংশোধন, পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজন করা হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু - dainik shiksha পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আইইউটির ৩ ছাত্রের মৃত্যু অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত - dainik shiksha অনার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বাদ দেয়া উচিত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ১ম থেকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে - dainik shiksha প্রাথমিকে ২০ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হচ্ছে স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত - dainik shiksha স্কুল শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা উচিত নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প - dainik shiksha নতুন পাঠ্য বইয়ে থাকছে শহীদ আবু সাঈদ ও মুগ্ধের বীরত্বগাথার গল্প শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি - dainik shiksha শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে - dainik shiksha গুচ্ছভুক্ত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চম পর্যায়ের ভর্তি আজকের মধ্যে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0062899589538574