শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময়

মাছুম বিল্লাহ, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সচিবালয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে মিটিং করেন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান। তিনি সেখানে বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রটিপূর্ণ। দেশে উদ্যোক্তাদের একটি প্রজন্ম তৈরি করতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে। তিনি আরো বলেন, মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। তবুও, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরিপ্রার্থী তৈরি করে, যা ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সংষ্কার করা উচিত যাতে এটি একটি প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের তরুণদের মধ্যে সৃজনশীলতার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। পরীক্ষার নম্বরের ওপর জোর না দিযে, সৃজনশীলতার দিকে নজর দিতে হবে। 

প্রধান উপদেষ্টা একজন শিক্ষক ছাড়াও, নোবেলজয়ী এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন দেশের শিক্ষা এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার তুলনা এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের শিক্ষা কতোটা উপযোগী সেই বিষয়গুলোতেই মূলত আলোকপাত করেছেন। আমাদের শিক্ষা ত্রুটিপূর্ণ, যার কারণে আমরা পিছিয়ে আছি। কিন্তু, কেনো? এ জন্য কি শুধু শিক্ষকেরা দায়ী? শুধু সরকার দায়ী? শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা দায়ী, নাকি সামাজিক অবস্থা ও বিশ্বের দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও এর সঙ্গে জড়িত? এগুলো আমাদের ভাবনার বিষয়, আমাদের চিন্তার খোরাক।

আমরা বিভিন্ন কারণে শিক্ষার মানে পিছিয়ে আছি। পড়াশোনা করা একটি কঠিন কাজ। প্রতিটি বিষয় পড়া বা পড়ানোর জন্য যেমন শিক্ষককে তেমন শিক্ষার্থীদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, প্রচুর অনুশীলন করতে হয়। তারপর একটি বিষয় যখন শিক্ষার্থী বোঝেন তখন তারা আনন্দ পান। কিন্তু আমরা সেই বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছি বহু বছর। আমরা বলছি শিক্ষার্থীরা আনন্দের মাধ্যমে শিখবেন, আরো এক কিংবা দুইধাপ এগিয়ে আমরা বুঝালাম, শিক্ষার্থীরা কোনো ধরনের মূল্যায়ন বা চাপের মধ্যে থাকবেন না, তারা শুধুই আনন্দ করবেন। ফলে, মান চলে গেলো শূন্যের কোঠায়। একজন দোকানদার যিনি সমস্ত কাস্টমারের সঙ্গে ভালোভাবে ডিল করেন, কথা বলেন, দিনরাতের একটি বড় সময় দোকান খোলা রাখেন, বেচাবিক্রি করে ঘাম ছুটিয়ে ফেলেন,  দিন শেষে, মাস শেষে এবং বছর শেষে তিনিই প্রচুর লাভ করেন। আর তখন তিনি আনন্দ পান ও সেই আনন্দের কারণে আরো পরিশ্রম করেন। ফলে তার ব্যবসার প্রসার ঘটে। এটিই আনন্দ। আর যিনি দোকান না খুলে বাসায় গিয়ে প্রায়ই আনন্দের সঙ্গে ঘুমান, তার ব্যবসা লাটে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে সবকিছু বিক্রি দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে হয়। কারণ, তিনি শুধুই আনন্দ করেছেন। শিক্ষার আনন্দও তদ্রুপ। 

পরিশ্রম করে পড়লে, অনুসরণ করলে শিক্ষার্থীরা শেখেন এবং সেই শেখার আনন্দই প্রকৃত আনন্দ। প্রকৃত আনন্দ মানে বইপুস্তক বাদ দিয়ে, হাসাহাসি, নাচানাচি, খেলাধুলা করা আর কোনো ধরনের মূল্যায়নের সম্মুখীন না হওয়া আনন্দ নয়। শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেয়ার আলোচনা, প্রস্তুতি এবং আনন্দ দেয়া (?) ইত্যাদি ধাপগুলোতে অনেক বছর কেটে গেছে। ফলে, বিশ্রাম নেয়া ব্যবসায়ীর মতো অবস্থা হয়েছে। 

এখানে আর একটি বিষয় যোগ হয়েছে। শিক্ষাবিদদের অধিকাংশই মুল্যায়ন নিয়ে কথা বলেন এবং বলেছেন, ওয়ার্কশপ করেছেন, করিয়েছেন, গবেষণা করেছেন। কিন্তু কি মূল্যায়ন করবো, কাদের মূল্যায়ন করবো সেই বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকে গেছে। এক সময় দুর্বল শিক্ষার্থীরাও বই দেখে কমবেশি পড়তে পারতেন। কিন্তু আমাদের ভুল ব্যাখ্যা আর উদ্দেশ্যমূলকভাবেই হোক মূল্যায়ন নিয়ে ভিন্ন বিষয় চালু করার ফলে বহু শিক্ষার্থী বাংলা ইংরেজি দেখে পড়তেই পারেন না। বইয়ের বিষয়বস্তু বুঝা বা বুঝানো কিংবা সৃজনশীলতা সে তো অনেক দুরের কথা। 

শিক্ষার মান বৃদ্ধির প্রধান কারিগর কিন্তু শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতনের কারণে কি ধরনের শিক্ষক আমরা এতো বছর পেয়েছি সেটি নিয়েও ভাবতে হবে। তারপর সরকারি শিক্ষকগণ বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি, অন্যান্য পেশার সঙ্গে তাদের অবস্থান তুলনা করা নিয়ে ব্যস্ত, মহাব্যস্ত, আন্দোলন। বেসরকারি শিক্ষকগণ এমপিওভুক্তি, বেতনবৃদ্ধি আর জাতীয়করণ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। সব ধরনের ব্যস্ততাই আছে এবং ছিলো কিন্তু নেই শুধু শিক্ষা। এই জায়গাটিতে শিক্ষার্থী যেমন দুর্বল শিক্ষকদেরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই অবস্থা। কারণ, কারোরই তো বিষয় চর্চায় নেই এখানে শুধু কি শিক্ষকের দোষ না তা বলছি না। অবস্থা কেমন সেটি বলছি। 

শিক্ষার্থীরা পড়ছেন না। কারণ, পড়ে কী হবে? কিছু পড়লেও পাস, না পড়লেও পাস। মূল্যায়ন অবস্থার দুর্গতি! একেতো সব শিক্ষক তো উত্তরপত্র মুল্যায়ন করতে পারেন না। আবার ওপর থেকে বলা হয় কোনো শিক্ষার্থী যাতে ফেল না করেন। ফলে দিনে দিনে যা হবার তাই হয়েছে। খাতা খালি রাখলেও পাস, না রাখলেও পাস। হাবিজাবি লিখলেও পাস, কিছু লিখলেও পাস, না লিখলেও পাস। পরীক্ষা দিলেও পাস, না দিলেও পাস। এসব বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া ও অনুশীলন শ্রেণিকক্ষ থেকে উধাও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উধাও। কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বুঝেছেন কি না সেটি যাচাই করার জন্য শ্রেণিকক্ষ। আভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ছাড়াও আমরা জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা নিয়ে থাকি। কিন্তু সব পর্যায়েই এক ধরনের ছাড়, এক ধরনের কম্প্রোমাইজ, এক ধরনের দয়া প্রদর্শন করার বিষয় লক্ষ্য প্রচলিত। ফলে, প্রকৃত মূল্যায়ন কোথাও হচ্ছে না। কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছে না। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয় কতোটা বোঝাল। সবাই কতো নম্বর পেয়েছে সেটিই দেখে। তাই প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নম্বর নিয়ে সবাই ব্যস্ত। নম্বর নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সৃজনশীলতার জায়গা সেখানে থাকে না, সেটিই হয়ে ওঠে মুখ্য। এই নম্বর প্রার্থীরা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান কারিগর। ব্যারিস্টার ফুয়াদ প্রায়ই বলেন, সবচেয়ে অপদার্থ, সবচেয়ে স্বার্থপর, সবচেয়ে বাস্তবজ্ঞানবিবর্জিত ছেলেটিই হন বিসিএস অফিসার। তার বিচারসহ কোনো সিদ্ধান্তই তো সঠিক হয় না। ফলে বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ব্যবস্থা সবই হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। এসব শিক্ষার্থীদের নেই কোনো বাস্তবজ্ঞান, নেই সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে কোন সচেতনতা, নেই মানুষের সাথে ডিল করার কোন অভিজ্ঞতা। ক্লাসমেটকে সাহায্য না করে, খাতা লুকিয়ে অন্যদের চেয়ে কত বেশি নম্বর পাওয়া যায়, এই ছিল এসব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আর প্র্যাকটিস। প্রধান উপদেষ্টার কথার মধ্যেও অনেকটা তাই ফুটে উঠেছে। 

আর একটি বলেছেন, আমাদের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ক্রিয়েটিভ করছে না। শ্রেণিকক্ষে যে শিখন শেখানোর অবস্থা, অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় পর্যায়ে, মুল্যায়নের অবস্থা তাতে শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষকদের ক্রিয়েটিভ হওয়ার সুযোগ খুবই সংকুচিত, সেটি প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন, এসব কিছুই কি বর্তমান সরকারকে দেখতে হবে? যুগ যুগ ধরে যেসব সমস্যার পাহাড় জমেছে শিক্ষা ক্ষেত্রে সেগুলো এ সরকারের পক্ষে সব সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে, শুরু করতে হবে শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষ থেকে, বোর্ড কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে, শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবং সর্বোপরি অভিভবাকদের এবং সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা একটি সার্টিফিকেট নিয়ে শুধুমাত্র তাকে কে চাকরি দেবে এ জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের উদ্যেক্তা বানানোর জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন এবং বাস্তবে নিজে উদ্যেক্তা হয়ে অন্যদের কাজের ব্যবস্থা করেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার সময় বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, দেশি ও বিদেশি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কার্যকরী সংযোগ স্থাপন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা থিওরিটিক্যাল শিক্ষা ছাড়াও বাস্তব শিক্ষা অর্জন করতে পারেন। 

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন, জেনেশুনে পরীক্ষায় পাস করতে হয়। সেজন্য মন্ত্রণালয় থেকে, মাউশি অধিদপ্তর এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা যদি দয়ার পাস বন্ধ করে দেন তাহলে শ্রেণিকক্ষে পড়াশুনা হবে, প্রতিষ্ঠান ও বিষয় শিক্ষকেরা তৎপর হবেন। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034668445587158